পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি ফ্যামিলিটেক্স বন্ধ হয়ে গেছে, এমন তথ্যে সেটিকে উৎপাদনে ফেরাতে পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। কিন্তু কোম্পানিটি কেবল উৎপাদনে আছে এমন নয়, করোনার মধ্যে উৎপাদন সক্ষমতা দ্বিগুণ করে পূর্ণ সক্ষমতার অর্ধেকটা এরই মধ্যে ব্যবহার হচ্ছে। আবার নতুন করে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে।
কিন্তু কোম্পানিটির পক্ষ থেকে পুঁজিবাজারে এ বিষয়ে কোনো তথ্য দেয়া হচ্ছে না। গত জুনে অর্থবছর শেষ হলেও গত ডিসেম্বর পর্যন্ত দ্বিতীয় প্রান্তিকের পর কোনো প্রান্তিকও ঘোষণা করা হয়নি।
২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কারখানাটি চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত। এর উদ্যোক্তা-পরিচালকরা ঘোষণা না দিয়ে হাতে থাকা শেয়ারের প্রায় সবই বিক্রি করে দিয়েছেন।
বিএসইসি বন্ধ ও লোকসানি ১২টির বেশি কোম্পানিতে প্রাণ ফেরাতে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার মধ্যে একটি এই ফ্যামিলিটেক্স।
গত ফেব্রুয়ারিতে বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়। তারপর অনেকবার আলোচনায় আসে কোম্পানিটি আর চালু করা সম্ভব হবে না। বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম এমনও বলেন যে, তারা কারখানামালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। পরে কারখানা বিক্রি করে দেয়ার পরিকল্পনার কথা বলেন।
কিন্তু সেপ্টেম্বরের শুরুতে পুনর্গঠন করা বোর্ডের সদস্যরা পরিদর্শন করেন ফ্যামিলিটেক্সের কারখানা। সেখান থেকে ফিরে তারা জানালেন, কোম্পানির সক্ষমতার প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদনে।
সেপ্টেম্বরের পর দুই মাসে উৎপাদন আরও বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিরাজ-ই-মোস্তফা নিজে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন এই তথ্য। তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে পোশাক রপ্তানি অনেক কমেছে। এরপরও আমরা অনেক চেষ্টা করছি ঘুরে দাঁড়াতে। এখন আমাদের সক্ষমতার অর্ধেক চালু আছে। ধীরে ধীরে আমরা পুরোদমে উৎপাদনে যাব। ধীরে ধীরে সবগুলো ইউনিট চালু করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রায় ২ হাজার শ্রমিক এখন নিয়মিত কাজ করছেন। নতুন নতুন কার্যাদেশ পাচ্ছি। এভাবে চলতে থাকলে শিগগির আমরা মুনাফায় ফিরব।’
ঠিক সময়ে আর্থিক প্রতিবেদন কেন দেয়া হয় না জানতে চাইলে ফ্যামিলিটেক্সের এমডি বলেন, ‘কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে নতুনদের দায়িত্ব দিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। আর্থিক প্রতিবেদনসহ সব বিষয় পরিচালনা পর্ষদ দেখভাল করে। তারাই বিষয়টি বলতে পারবে।’
- আরও পড়ুন: ফ্যামিলিটেক্সে উৎপাদন চলছে
এই বিষয়ে জানতে বিএসইসির মনোনীত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ফরজ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, যে প্রান্তিকগুলোর তথ্য প্রকাশ করা হয়নি, সেটি জানাবে আর বছর শেষে আর্থিক প্রতিবেদন আমাদের কাছে পাঠাবে। কিন্তু এখনও এ বিষয়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে কিছুই পাঠানো হয়নি।’
পরিদর্শনে যাওয়া পর্ষদ সদস্যদের কোম্পানির পরিচালকের পক্ষ থেকে আর্থিক প্রতিবেদন পাঠানোর অঙ্গীকার করা হয়। তবে কথা রাখেনি তারা
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিমের কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা কিছু জানি না।’
তবে রেজাউল করিম কিছু জানেন না বললেও নতুন পরিচালনা পর্ষদ গত সেপ্টেম্বরেই বিএসইসিকে কোম্পানিটির বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। তারা কোম্পানিটিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সাবেক পরিচালক মেরাজ মোস্তফা কায়সারকে দিয়েই কোম্পানিটিকে পরিচালনা করার পক্ষে।
তালিকাভুক্ত হওয়ার পর সব পরিচালক গোপনে শেয়ার বিক্রি করে দিলেও মেরাজ মোস্তফা নামে একজন পরিচালক তা করেননি। তিনিই এখন ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন।
কোম্পানি চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় চলতি মূলধনের ব্যবস্থা করে দিলে তিনি আগের মতোই উৎপাদন শুরু করতে পারবেন বলে গত সেপ্টেম্বরে নতুন পরিচালনা পর্ষদ সদস্যদের জানিয়েছেন। তবে এই প্রতিবেদনের বিষয়ে বিএসইসি কোনো বক্তব্য দেয়নি।
পুনর্গঠিত পর্ষদের প্রধান ড. মো. ফরজ আলী গত সেপ্টেম্বরে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন যিনি কোম্পানিটি পরিচালনা করছেন, তিনি চালালেও কোম্পানির কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন করতে হবে, অন্য কাউকে দিয়ে চালালেও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ফলে যিনি বর্তমানে এটি পরিচালনা করছেন তাকে দিয়ে করানোই ভালো। কারণ, তার এ খাতের ভালো অভিজ্ঞতা আছে।’
পুঁজিবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ’-এর সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিএসইসি যদি বলে তারা কিছুই জানে না, তাহলে আমরা বিনিয়োগকারীরা কোথায় যাব? যদি ফ্যামিলিটেক্সের এই ঘটনাটি ঘটে, তাহলে বিএসইসি, ডিএসইর উচিত তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চাওয়া। সরেজমিনে গিয়ে দেখে এসে তারাই বিনিয়োগকারীদের আরও তথ্য দিতে পারে।’
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ব্র্যাক ইপিএলের সাবেক গবেষণা প্রধান দেবব্রত কুমার সরকার বলেন, ‘যেহেতু বোর্ড পুনর্গঠন করে দেয়া হয়েছে, সেহেতু সেখানে কী হচ্ছে না হচ্ছে, সেটি তদারকির দায়িত্ব নতুন বোর্ডের। তবে বোর্ডে যারা আছে, তাদের বেশির ভাগই শিক্ষক। তারা হয়তো বিষয়টির দেখভাল করতে পারছেন না, তাই তাদের কাছে তথ্যগুলো আসছে না।’
তালিকাভুক্ত হওয়ার ৭ বছর আগে ২০০৬ সালে বাণিজ্যিক উৎপাদনে আসে ফ্যামিলিটেক্স। প্রথম দিকে মুনাফায় থাকলেও গত কয়েক বছরে উদ্যোক্তাদের ব্যর্থতা, দ্বন্দ্ব, অদূরদর্শিতা, অপব্যবস্থাপনায় লোকসানি কোম্পানিতে পরিণত হয়। ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা লোকসান দিয়েছে তারা। তবে লোকসানের পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরের নিট লোকসান হয় ৫ কোটি ৩৩ লাখ টাকা। শেয়ারপ্রতি এই লোকসান ছিল ১৫ পয়সা। আগের বছর লোকসান ছিল ৮ পয়সা, তার আগের বছর ৭ পয়সা, তার আগের বছর ৪ পয়সা।
লোকসানে থেকেও ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫ শতাংশ করে বোনাস শেয়ার দিয়েছিল কোম্পানিটি। তবে পরের দুই বছর লভ্যাংশ দেয়নি।
২০২০ সালের জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শেয়ারপ্রতি ১৩ পয়সা লোকসান দেখানোর পর কোম্পানিটির পক্ষ থেকে আর কোনো তথ্যই প্রকাশ করা হয়নি।
ফ্যামিলিটেক্সের আদ্যোপান্ত
২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। ১০ টাকা মূল্যমানের সাড়ে ৩ কোটি শেয়ার ছেড়ে তারা সংগ্রহ করে ৩৫ কোটি টাকা।
তালিকাভুক্তির পর ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক হিসাব পর্যালোচনা করে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। তবে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১০০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ।
ওই বছর কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় দেখানো হয় ৭ টাকা ২৬ পয়সা আর শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য হয় ২১ টাকা ৭২ পয়সা। এই লভ্যাংশ ঘোষণার পরদিন ১ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ার দর দাঁড়ায় ৬২ টাকা, যদিও একপর্যায়ে দাম ৭৪ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছিল।
বিপুল পরিমাণ বোনাস শেয়ার দেয়ার পর থেকেই ফ্যামিলিটেক্সের আয় কমতে থাকে। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সমাপ্ত অর্থবছরে তারা সবশেষ মুনাফা করেছিল। তখন শেয়ারপ্রতি আয় হয় ৮২ পয়সা। এর পরের চার বছর ধরে লোকসান দিচ্ছে তারা।
২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় সাড়ে ৪ পয়সার মতো। পরের বছর লোকসান হয় ৭ পয়সা, ২০১৯ সালে লোকসান হয় ৮ পয়সা। আর ২০২০ সালে লোকসান হয় ১৫ পয়সা।
২০১৩ সালে ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দেয়ার পরের বছর তারা দেয় আরও ১০ শতাংশ বোনাস। এর পরের তিন বছর দেয় ৫ শতাংশ করে। কিন্তু গত দুই বছর কোনো লভ্যাংশই দেয়া হয়নি।
অথচ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে কোম্পানির আয় ক্রমেই বাড়ছিল। তালিকাভুক্তির আগে তিন বছরের আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিতে হয় বিএসইসিতে।
সেখানে দেখা গিয়েছিল ২০১১ ও ২০১২ সালে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছিল চার গুণের বেশি। আর তালিকাভুক্ত হওয়ার বছরে মুনাফা বাড়ে আরও ৭৬ শতাংশ।
এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকরা আরেকটি আইনবিরুদ্ধ কাজ করেন। পুঁজিবাজারে ঘোষণা না দিয়েই উদ্যোক্তা-পরিচালকরা তাদের হাতে থাকা সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করে দেন।
এই বিষয়টি তদন্তে ডিসেম্বরের শেষে একটি কমিটি করে বিএসইসি। তারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছে কি না, সেটি এখনও জানা যায়নি। আর এ জন্য পরিচালকদের তেমন কোনো শাস্তিও পেতে হয়নি।
কোম্পানিটির ৩৫ কোটি ৪০ লাখ শেয়ারের মধ্যে এখন মাত্র ৪.০২ শতাংশের মালিক কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। অথচ বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী অন্তত ৩০ শতাংশ শেয়ার ধরে রাখতে হবে মালিকপক্ষ।
এই কোম্পানির ৭৭.৫৭ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকা কোম্পানির শেয়ার দরও একেবারে তলানিতে। একপর্যায়ে দাম ২ টাকা ৪০ পয়সায় নেমে আসে। তবে বোর্ড পুনর্গঠনের পর গত আগস্টে দাম বেড়ে একপর্যায়ে ৬ টাকা ৮০ পয়সা পর্যন্ত পৌঁছে। তবে এরপর দাম ধীরে ধীরে কমে আসছে। সোমবার দাম দাঁড়িয়েছে ৪ টাকা ৪০ পয়সা।