বেশ কিছুদিন ধরে নানান অসুখে ভুগলেও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা নিয়ে হঠাৎ করে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে। তার শারীরিক অবস্থা কেমন, তার কী হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্যই দিচ্ছে না দল বা পরিবার। তবে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর ব্যাপারে জোর তাগিদ দেয়া হচ্ছে।
সরকারের পক্ষ থেকে বিদেশে নিতে হলে কীভাবে আবেদন করতে হবে- সে বিষয়ে বক্তব্য দেয়া হলেও বিএনপির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো আবেদন করা হয়নি।
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, তাদের নেত্রী জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আর যে রোগটি হয়েছে, তার চিকিৎসা দেশে সম্ভব নয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ভাই শামীম ইস্কান্দর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে একটি আবেদন করেছেন। এর আগে চার দফা আবেদন করা হলেও তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক একাধিকবার জানিয়েছেন, দণ্ডবিধির ৪০১ ধারা ব্যবহার করে খালেদা জিয়ার দণ্ড যে স্থগিত করা হয়েছে, সেই একই ধারা দ্বিতীয়বার প্রয়োগ করার সুযোগ নেই। তিনি জানিয়েছেন, বিএনপি নেত্রীকে কারাগারে গিয়ে নতুন করে আবেদন করতে হবে, অথবা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে দায়মুক্তির সুযোগ নিতে হবে।
তবে বিএনপি নেত্রীর পরিবার এর কোনোটিতেই রাজি নয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাদণ্ড হওয়ার দুই বছর পর ২০২০ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাহী আদেশে দণ্ড স্থগিত হয়। এই মুক্তির সময়ই শর্ত ছিল বিএনপি নেত্রী দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।
বাসায় ফেরার ১৩ মাস পর গত এপ্রিলে করোনা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন খালেদা জিয়া। পরে বাসায় ফেরেন ১৯ জুন।
১২ অক্টোবর আবার হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। বাসায় ফেরেন ৭ নভেম্বর। সে সময় বিএনপি নেত্রীর বায়োপসি করা হয় বলে দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়। বাসায় ফেরার পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছিলেন, তাদের নেত্রী ভালো আছেন।
তবে গত ১৩ নভেম্বর আবার খালেদা জিয়াকে হাসপাতালে নেয়া হয়। পরদিন ভর্তি করা হয় করোনারি কেয়ার ইউনিট বা সিসিইউয়ে।
এরপর থেকে বিএনপির পক্ষ থেকে ক্রমাগত তাদের নেত্রীকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার দাবি জানানো হতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দাবি নাকচ করার পরদিনই এই দাবিতে আগামী ২০ নভেম্বর অনশনের ডাক দিয়েছে দলটি।
এই অবস্থাতেও দলের পক্ষ থেকে অসুস্থতা নিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আসেনি।
জানতে চাইলে বিএনপি নেত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি একজন চিকিৎসক। আমার কাজ রোগীর সেবা করা। রোগীর কী অবস্থা সেটা আমার কাছে জানতে চেয়ে বারবার ফোন দিয়ে বিরক্ত করবেন না। আই এম টু মাচ টায়ার্ড। মহাসচিবের কাছে জানতে চাইবেন ম্যাডামের অবস্থা, আমার কাছে না।’
এ বিষয়ে জানতে মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি।
তবে বৃহস্পতিবার রাজধানীতে এক আয়োজনে তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ। তিনি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তিনি এমন একটি পর্যায়ে রয়েছেন, যেখানে সুচিকিৎসা না হলে এমন অবস্থায় চলে যাবেন যে, আর কোনো চিকিৎসা দিয়েই লাভ হবে না বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।’
একই দিন অন্য একটি আয়োজনে তিনি বলেন, ‘আমাদের এভারকেয়ার হাসপাতালের চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন তাকে সুস্থ করে তোলার। সুস্থ করে ঘরে পাঠিয়েছিলেন, আবার তিনি বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হয়েছেন। একটা অসুখ তার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বাইরে চিকিৎসা করতে পাঠানোটা জরুরি।
‘ডাক্তাররাই বলছেন, তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠালে তিনি সুস্থ হবেন। তারা আশা করছেন সেটা। দেশের একটা উন্নত হাসপাতাল, তারপরেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছেন, বেগম জিয়ার চিকিৎসার সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা এখানে নেই। বিদেশে পাঠাতে হবে। আজকে অন্য দলগুলোও বলছেন এই কথা, কিন্তু আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের নেত্রী সেটিকে গ্রহণ করছেন না।’
হাসপাতালে কী চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে খালেদা জিয়াকে?
দলীয় সূত্র, পরিবার ও খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীলদের সঙ্গে নিউজবাংলার আলাপকালে জানা গেছে নানা তথ্য।
একাধিক ব্যক্তি নিশ্চিত করেছেন, গত তিন দিন ধরে অক্সিজেনের প্রয়োজন হচ্ছে বেগম জিয়ার। কখনও কখনও এক থেকে দুই ঘণ্টায় অক্সিজেন লাগছে ২ থেকে ৩ লিটার। তবে সব সময় অক্সিজেন লাগছে না।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শরীরের খনিজ উপাদানগুলো ওঠানামা করছে। প্রধান ইলেকট্রোলাইট অর্থাৎ সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম ও ক্লোরিন উপাদানের পরিমাণ কমে গেছে।
একজন চিকিৎসক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ম্যাডামকে মূলত সিসিইউর আদলে আইসিউর সেবা দেয়া হচ্ছে। তার প্রথম বায়োপসি করার পর যে ছোট্ট একটি ক্ষতিকর অংশ পাওয়া যায়, তা নির্মূল করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন নতুন করে জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। কিডনির ক্রেটেনিন বাড়ছে। তাপমাত্রা স্বাভাবিক থাকলেও ডায়াবেটিস একেবারে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। তাই ইনসুলিনের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে কঠিন হয়ে পড়ছে।’
তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার শরীরে প্রচণ্ড দুর্বলতা। তিনি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেন না। রক্তের হিমোগ্লোবিনও অনেক কমে গেছে। রক্তের হিমোগ্লোবিন বাড়াতে এরই মধ্যে দুই ব্যাগ রক্ত দেয়া হয়েছে।’
কী খাচ্ছেন খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়ার প্রয়োজনমাফিক তরল খাবার বাসা থেকে রান্না করে হাসপাতালে সরবরাহ করা হচ্ছে। তার ছোট পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান সিঁথি হাসপাতালে অবস্থান করে খাবারের বিষয়ে খোঁজখবর নেন।
পরিবারের সদস্যদের বাইরে হাসপাতালে এখন বিএনপির পক্ষ থেকে শুধু মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস যাচ্ছেন।
বুধবারও প্রায় তিন ঘণ্টা হাসপাতালে ছিলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তবে তারাও সিসিইউর কাচের দেয়ালের বাইরে থেকে শুধু সালাম বিনিময় করেন। খালেদা জিয়াও ইশারায় জবাব দেন।
একই দিন বিএনপি নেত্রীকে দেখতে হাসপাতালে যান নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তাকে একজন চিকিৎসক জানিয়েছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অবস্থা সঙ্গিন।
মান্না নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি গ্লাসের বাইরে থেকে দেখেছি। ভেতরে ঢোকা নিষেধ। ড. জাহিদ মন খারাপ করে মাথা নিচু করে জানিয়েছেন, ওনার অবস্থা খুব একটা ভালো না।’
সরকারের অবস্থানে হতাশ পরিবার
খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার পরও বিদেশে উন্নত চিকিৎসার আবেদন সরকার কার্যত নাকচ করে দেয়ায় হতাশ তার পরিবার।
বিএনপি নেত্রীকে বিদেশে যেতে দেয়া হবে কি না, বুধবার একজন গণমাধ্যমকর্মীর এমন প্রশ্নে বিরক্তি প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘আমার কাছে কী চান, কীভাবে, বলেন তো? খালেদা জিয়াকে কারাগার থেকে বাসায় থাকতে দিয়েছি, চিকিৎসা করতে দিয়েছি, এটাই কি বেশি না?
‘আপনাকে কেউ যদি হত্যা করার চেষ্টা করত, আপনি তাকে গলায় ফুলের মালা দিয়ে নিয়ে আসতেন? বলেন আমাকে?’
প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার বড় বোন সেলিমা ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উনি যে কতটা অসুস্থ বলে বোঝাতে পারব না। রাত-দিন দোয়া করছি ওনার জন্য। সবাই বিদেশে যায় চিকিৎসা নেয়, খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে যত আইন। আমরা আবার আবেদন করছি, আমরা রাজনীতিবিদ না। রাজনীতিও করি না। আমরা আমাদের ওয়েতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেছি। আর কী-ইবা করার আছে?’