পানি নিষ্কাশন বন্ধ হয়ে সাতক্ষীরা পৌরসভায় জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। পৌর শহরের প্রায় অর্ধেক এলাকায় ছয় মাস ধরে পানি জমে আছে।
ঘরের ভেতরও পানি থাকায় রান্নাসহ গৃহস্থালির কাজে মারাত্মক দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন লক্ষাধিক মানুষ। কোমর পর্যন্ত পানিতে নেমে যাতায়াত করতে হচ্ছে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ অন্যদের।
দেখা গেছে, সাতক্ষীরা পৌরসভায় বসবাসরত তিন লক্ষাধিক বাসিন্দার মধ্যে এক তৃতীয়াংশেরই বসবাস জলাবদ্ধ এলাকায়। শহরের ইটাগাছা, কামালনগর, মধুমোল্লারডাঙ্গী, বকচরা, রইচপুর, বদ্দীপুর কলোনি ও বাকাল এলাকার অধিকাংশ স্থানেই আটকে আছে পানি।
কোনো কাজে বাড়ির বাইরে যেতে হলেও তাদের প্রায় কোমর সমান পানি পার হয়ে যেতে হচ্ছে। এক বাসা থেকে অন্য বাসায় যেতে অনেকে ব্যবহার করছেন ভেলা।
দীর্ঘদিন ধরে এমন অবস্থা চললেও জলাবদ্ধতা নিরসনে কর্তৃপক্ষ কোনো উদ্যোগ নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা।
বদ্দীপুর কলোনি এলাকার হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের জীবন তো খুবই ভয়াবহ। পানি স্থায়ীভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ঘের মালিকরা শক্তপাড় দিয়ে বসে আছে। পানি সরার লাইন নেই।
‘স্থানীয় সংসদ সদস্য কোনো ব্যবস্থা নেন না। মেয়রও কোনো ব্যবস্থা নেন না। রাস্তার পুরোটাই পানি। সেখানে কচুরিপনা জন্মেছে।’
একই এলাকার বাসিন্দা মাহফুজা খাতুন বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্টে আছি। উঠানে পানি, রাস্তায় পানি, ঘরেও পানি। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে খুবই কষ্টে আছি। পানি সরছে না শুধু ঘেরের কারণে।
‘ছোটবেলায় দেখেছি, ড্রেন দিয়ে পানি নদীতে পড়ত। এখন যাওয়ার রাস্তা নেই। যেখানকার পানি সেখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে, বরং বাইরের পানি ভেতরে ঢুকছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পৌরসভার বাসিন্দা। শহরে বাস করার চেয়ে আমাদের তো ইউনিয়নে বাস করা ভালো ছিল।’
কলেজ রোড এলাকার আসমা খাতুন বলেন, ‘আমরা এই পৌরসভার মধ্যে খুব কষ্টে আছি। এখানে রান্নার সমস্যা, খাওয়ার সমস্যা, বাথরুমের সমস্যা, সবখানে সমস্যা। গ্যাসে একবার কোনো রকমে রান্না করছি। পানিতে ডুবে আছি। ঘর থেকে বাইরে বের হওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই আমাদের।’
সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী হাফসা খাতুন জানায়, সড়কগুলো পানিতে ডুবে থাকে। হাঁটতে গেলে কাপড় ভিজে যায়। খুব কষ্ট করে তাদের স্কুলে যাওয়া-আসা করতে হয়।
কাটিয়া মাঠপাড়া এলাকার লতিফুর রহমান বলেন, ‘পানি বেতনা নদীতে যায় না। প্রতিবার বাঁধ বেঁধে পাম্প লাগিয়ে সেচ দেয়া হয়। এবার পানি বেশি। কারো কোনো অনুদান আমরা পাই না। অনেকেই ছবি তুলে নিয়ে যায়, কিন্তু কোনো কাজ হয় না। কাউন্সিলরদের বললে তারা বলে, দেখব, কিন্তু দ্যাখে না।’
জেলা নাগরিক কমিটির যুগ্ম সদস্য সচিব আলী নুর খান বাবুল বলেন, ‘আমরা জেলা প্রশাসকের কাছে ১৩ দফা প্রস্তাবনা দিয়েছি। শহরে জলাবদ্ধতার দুটি কারণ। একটি হলো অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘের, অপরটি নদী ভরাট।
‘এত দুর্ভোগ, কোনো জনপ্রতিনিধির মাথাব্যথা নেই। ভোট এলে প্রতিশ্রুতি। ভোট শেষে কারো মনে থাকে না। এই প্রতিশ্রুতির মধ্যে সাতক্ষীরাবাসী ৬ বছর ধরে আছে।’
সাতক্ষীরা শহরের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত প্রাণসায়র খাল। এই খালকে বেতনা ও মরিচ্চাপ নদীর সঙ্গে সংযুক্ত করলে সমস্যার সমাধান হবে বলে জানান স্থানীয়রা।
জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম বাবলা বলেন, ‘প্রাণসায়র খাল দক্ষিণে মরিচ্চাপে মিশিয়ে দিলে এবং পূর্বে ও উত্তরে বেতনার সঙ্গে মিশিয়ে দিলে জলাবদ্ধতার সমাধান হবে। এ ছাড়া ব্যক্তিকে সচেতন হতে হবে এবং ড্রেনেজ সিস্টেমে সবাইকে সহযোগিতা করতে হবে।’
মাছের ঘেরের কারণে পানি নিষ্কাশন বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে জানালে তিনি বলেন, ‘পানি সরতে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে এটা ঠিক। আবার নিচু এলাকায় মাছ চাষে অনেকে উৎসাহিত হচ্ছে। তবে সবার উচিত পৌরবাসির স্বার্থে ঘের বেঁধে মাছ চাষ না করা।’
পৌরসভার মেয়র তাশকিন আহমেদ চিশতি জানান, জলাবদ্ধতা সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান সমস্যা। পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করছেন। শিগগিরই একটা ভালো ফল পাবেন বলে আশা করছেন।
সাতক্ষীরা-২ আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ রবি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ৪৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছেন। এই টাকাটা কাজে লাগালে পৌরসভা বা শহরের নিম্নাঞ্চল জলাবদ্ধতার হাত থেকে রক্ষা পাবে। তবে খনন কাজটা হতে হবে যথাযথ।’
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, নদীভরাট শহরে জলাবদ্ধতার প্রধান কারণ। বেতনা ও মরিচ্চাপ নদী খনন করা হলে জলাবদ্ধতা থাকবে না।
সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শহরের পানি সরবে কীভাবে? নিচু জমি উঁচু করে ঘর-বাড়ি করলে পানি সরার জায়গা থাকে না। শহরের পানি যায় বেতনা ও মরিচ্চাপ দিয়ে। আর উত্তর দিকের পানি সরত সোনাই নদী দিয়ে। সোনাই নদী ভরাট হয়ে গেছে। সেখানকার পানির লেভেল সাধারণ এলাকা থেকে উঁচুতে থাকে।
‘শহরের দিকের পানি সরে বেতনা-মরিচ্চাপে। সেটাও ভরাট হয়ে আছে। ফলে পানি না সরে বিভিন্ন দিকে প্লাবন ডেকে আনে। বেতনা-কপোতাক্ষ-মরিচ্চাপের সংযোগ খাল অধিকাংশ দখল হয়ে গেছে। উচ্ছেদ করতেও সময় লাগবে। সব মিলিয়ে সমম্বিত একটা উদ্যোগ দরকার। তবে বেতনা ও মরিচ্চাপ খনন করা গেলে জলাবদ্ধতা সমস্যার ৭০ শতাংশ সমাধান সম্ভব হবে বলে মনে করি।’