করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকাকে ‘জনসম্পদ’ ঘোষণা দিয়ে তা বাংলাদেশে উৎপাদনে বিশ্বনেতাদের কাছে সুযোগ চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে এই বার্তা দিয়ে এসেছেন জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, উৎপাদনের পাশাপাশি বিশ্ব চাহিদাও মেটাতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বাংলাদেশ।
একাদশ জাতীয় সংসদের চলমান অধিবেশনের দ্বিতীয় দিন সোমবার সংসদকে তিনি এ কথা জানান।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে সৃজনশীল অর্থনীতি শাখায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তনে জাতিসংঘের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোকে ধন্যবাদ জানাতে আনীত প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন শেখ হাসিনা।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় দেশের যে সাফল্য, তার আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসিত হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এটা বলে এসেছি, আমরা নিজেরা ভ্যাকসিন তৈরি করতে চাচ্ছি। ভ্যাকসিন তৈরি করার যে বাধাগুলো আছে, সেগুলো আপনাদের সরিয়ে দিতে হবে। এটা উন্মুক্ত করতে হবে। এটা জনগণের প্রাপ্য, জনগণের সম্পদ হিসেবে দিতে হবে।’
বিশ্বের সবার জন্য করোনা প্রতিরোধী টিকা নিশ্চিতের দাবি তুলে সংসদ নেতা বলেন, ‘সারা বিশ্বের কোনো মানুষ যেন এই ভ্যাকসিন থেকে দূরে না থাকে। আমাদেরকে সুযোগ দিলে আমরা উৎপাদন করব, আমরা বিশ্বকে দিতেও পারব। সেই সক্ষমতা আছে। আমরা জমিও নিয়ে রেখেছি।’
জাতির পিতার নামানুসারে আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়ায় ইউনেসকোর মহাপরিচালক ও সব সদস্য এবং যারা এ স্বীকৃতি আদায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের সবার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সৃজনশীল অর্থনীতিতে তরুণ উদ্যোক্তাদের এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় প্রথমবারের মতো ‘ইউনেসকো-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ পেয়েছে উগান্ডার কাম্পালার বেসরকারি সংস্থা মোটিভ ক্রিয়েশন্স লিমিটেড।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে ইউনেসকো সদরদপ্তরে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার প্রধান অতিথি হিসেবে এ পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মোটিভ ক্রিয়েশন্সের পক্ষে পুরস্কার নেন কোয়ান গুজি।
মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের সময়ে বঙ্গবন্ধুর নামানুসারে এই পুরস্কার প্রবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক বলে মনে করেন শেখ হাসিনা।
পুরস্কারজয়ী মোটিভ ক্রিয়েশনসের মতো বাংলাদেশের তরুণরাও এগিয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা প্রধানমন্ত্রীর। তিনি বলেন, ‘উগান্ডার তরুণরা পুরস্কার পেয়েছে, একদিন বাংলাদেশেরও কোনো না কোনো উদ্যোক্তা এই পুরস্কার পাবে বলে আমি আশা করি।’
এ সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের নানা দিক নিয়ে সংসদে আলোচনা করেন তারই কন্যা শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ তিনি (বঙ্গবন্ধু) গড়ে তুলছিলেন। কত অল্প সময়ে, মাত্র সাড়ে তিন বছরে, এই সাড়ে তিন বছরে বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশে উন্নীত করেন। সকল আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ বাংলাদেশ লাভ করে।’
বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী রাজনীতির প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘পৃথিবীর অন্য কোনো দেশ স্বাধীনতার পর এত অল্প সময়ের মধ্যে এত স্বীকৃতি আদায় করতে পারেনি। যেটা বাংলাদেশ পেরেছিল একটি কারণে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আমাদের ছিল বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে।’
৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা নিয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের উদ্দেশ্য নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাদের মধ্যে একটাই চিন্তা ছিল, জাতির পিতাকে পরিবারসহ হত্যা করলে বাংলাদেশ যে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করেছে, বিজয়ী জাতি হিসেবে মাথা তুলে বিশ্ব দরবারে চলছে, সেই জায়গাটাকেই নষ্ট করা। স্বাধীনতার সুফল যেন বাংলাদেশের মানুষের ঘরে না পৌঁছায়। স্বাধীনতা যেন ব্যর্থ হয়। ওই বিজয় যেন ব্যর্থ হয়। এটাই ওদের প্রচেষ্টা ছিল।’
৭৫ পরবর্তী ২১ বছর সেভাবে দেশ পরিচালনা করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। কিন্তু দেশের এবং দেশের মানুষের যে উন্নয়ন করা যায় সেটা তার শাসনামলে প্রমাণিত হয়েছে বলেও সংসদকে অবহিত করেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ এখন পিছিয়ে নেই জানিয়ে সংসদ নেতা বলেন, ‘আমি ধন্যবাদ জানাই বাংলাদেশের জনগণকে, আমাকে বারবার তারা ভোট দিয়েছেন, সেবা করার সুযোগ দিয়েছেন। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।’
এক দশকের এই পরিবর্তনে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মর্যাদা বেড়েছে বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘এখন আর বাংলাদেশের কাউকে বাইরে গিয়ে কথা শুনতে হয় না।
‘অনলাইনে কেনা-বেচা, ব্যবসা, ই-কমার্স চালু করা, ই-টেন্ডার থেকে সবকিছু- এগুলো তো হয়েছে বাংলাদেশে, করেছি। আরও হবে, বাংলাদেশ আরও এগুবে। একটা জিনিস এক দিনে তো আর হয় না। ধাপে ধাপে করতে হয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাবমেরিন কেব্লের সংযোগ ফিরিয়ে দেয়াসহ অনেক ‘সর্বনাশা’ সিদ্ধান্ত অন্য সরকারগুলো নিয়েছে, যা বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে উঠে আসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণের কথাও। ৭৫ পরবর্তী সময়ে এই ভাষণ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল বলে জানান শেখ হাসিনা। সেই ভাষণ আজ বিশ্ব প্রামাণ্য দলিলের স্বীকৃতি পেয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এটাই আমাদের জন্য সব থেকে বড় সম্মানের। সেই ভাষণ, যে ভাষণ উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার চেতনাকে।’
বাংলাদেশের জন্য বিশ্ব দরবার থেকে মর্যাদা অর্জন করে নিয়ে আসা নিজের লক্ষ্য জানিয়ে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘কারণ এই দেশ জাতির পিতার অনেক ত্যাগের ফসল। তার সারাটা জীবন তিনি উৎসর্গ করেছেন এ দেশের মানুষের জন্য।’
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বাংলাদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত, ক্ষুধামুক্ত, উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়েই তার পথ চলা বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।