‘দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে দেশে ফিরে অনেক দিন বেকার ছিলাম। এভাবে তো আর সংসার চলে না। পরে আমাদের একটা পুকুরেই মাছের চাষ শুরু করি। আল্লাহর রহমতে আয় ভালো হয়। এখন আমি ১২টা পুকুরে মাছ চাষ করছি। মাছ বিক্রির টাকায় চলছে সংসার।’
বলছিলেন মৎসচাষি ও চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বাসিন্দা নুরুল হক।
চট্টগ্রামের শত শত বাসিন্দা মাছ চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। অনেক শিক্ষিত তরুণ এখন মাছ চাষ করছেন।
চট্টগ্রামে বদ্ধ জলাশয়ে মাছ উৎপাদন বেড়েছে। মৎস্য বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চট্টগ্রামে মাছ উৎপাদন হয়েছিল ৬৯ হাজার ১৫৫ টন। তিন বছরের ব্যবধানে ২০২০-২১ অর্থবছরে সেই উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার ১৪৯ টন। অর্থাৎ এই তিন বছরে উৎপাদন বেড়েছে ১০ হাজার ৯৯৪ টন। প্রবৃদ্ধির হিসেবে ১৫ দশমিক ৯ শতাংশ।
মৎস্য বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, এ জেলায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মাছ উৎপাদন হয়েছে ৭৫ হাজার ৪৯৬ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ৭৭ হাজার ৫৮৩ টন, যা ২০২০-২১ অর্থবছরে বেড়ে হয় ৮০ হাজার ১৪৯ টন।
চট্টগ্রাম মৎস্য দপ্তরের উপপরিচালক ফারহানা লাভলী জানান, মাছের জাত সম্প্রসারণ, মাছ চাষে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ কর্মী তৈরির মাধ্যমে মাছ চাষ করায় চট্টগ্রামসহ সারা দেশে বেড়েছে মাছ উৎপাদন।
চট্টগ্রামের শত শত বাসিন্দা মাছ চাষের দিকে ঝুঁকেছেন
চট্টগ্রাম জেলায় বদ্ধ জলাশয় আছে ২১ হাজার ১৪৮ দশমিক ৬ একর। এর মধ্যে পুকুরের জলায়তন ২১ হাজার ১৪৮ দশমিক ৫ হেক্টর। এ পুকুরগুলোতে গত অর্থবছরে (২০২০-২১ সালে) মাছ উৎপাদন হয়েছে ৭৪ হাজার ৮৯১ দশমিক ৬১ টন।
অন্যদিকে ৩ হাজার ২২৮ হেক্টরে রয়েছে চিংড়ি খামার। এ জলায়তনে চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৫৯৯ দশমিক ৩৫ টন।
বদ্ধ জলাশয়ে এখন দেশীয় প্রায় সব মাছই চাষ হচ্ছে। তবে বেশি চাষ হচ্ছে তেলাপিয়া, রুই, কাতল, মৃগেল, পাঙাশ, শিং, কৈ, মাগুর ও কার্পজাতীয় মাছের চাষ।
ফারহানা লাভলী বলেন, ‘শিক্ষিত তরুণদের অংশগ্রহণে বদ্ধ জলাশয়ে চাষ করা মাছ উৎপাদন বাড়ছে। বিশেষ করে করোনাকালে অনেক তরুণ মৎস্য অফিস থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মাছ চাষ করছেন। চলতি বছরে মোট উৎপাদিত মাছের সিংহভাগ উৎপাদন হয়েছে বদ্ধ জলাশয়ে। ভবিষ্যতে এ উৎপাদন আরও বাড়বে।’
এ জেলায় বদ্ধ জলাশয়ের মাছ বেশি চাষ হচ্ছে মিরসরাই, সীতাকুণ্ড, আনোয়ারা, পটিয়া, কর্ণফুলী, সাতকানিয়াসহ আরও কিছু এলাকায়। এ ছাড়া বাকি সব উপজেলায় এখন নতুন নতুন মৎস্য প্রকল্পের মাধ্যমে বদ্ধ জলাশয়ের মাছ চাষ বেড়েছে।
মিরসরাই বারইয়ারহাটের মৎস্যচাষি মনিরুল বলেন, ‘বদ্ধ জলাশয়ের মাছ চাষ বেশ লাভজনক। তবে মাছ চাষে আমাদের ছোটোখাটো কিছু সমস্যায় পড়তে হয়। চট্টগ্রামে সব সময় পোনা পাওয়া যায় না। কুমিল্লা থেকে আনতে হয়। এ ছাড়া শীতকালে পানিতে অক্সিজেনের সমস্যা দেখা দেয়। এতে কিছু মাছ মরে যায়। এ সময় পুকুরে কৃত্রিম অক্সিজেনের ব্যবস্থা করতে হয়, না হলে নতুন পানির ব্যবস্থা করতে হয়। এসব করার সাধ্য যাদের নেই, তারা ক্ষতির মুখে পড়েন।’
চট্টগ্রাম জেলায় সরকারি হ্যাচারি আছে মাত্র দুটি। এর মধ্যে পটিয়ার হ্যাচারি চালু রয়েছে। তবে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ মিরসরাইয়ের হ্যাচারিটি। বেসরকারি মৎস্য হ্যাচারি রয়েছে ১১টি।
এ জেলায় সরকারিভাবে পোনা উৎপাদন হয় মাত্র ৬ হাজার ২৩৩ লাখ, বেসরকারিভাবে ২৩৬ দশমিক ৫৫ লাখ। জেলায় প্রয়োজনের তুলনায় এটি অনেক কম। তবে ঘাটতি পূরণ করতে ময়মনসিংহ, যশোর ও কুমিল্লা থেকে পোনা আনা হয়।
এই বিষয়ে ফারহানা লাভলী বলেন, ‘আমাদের কিছু লিমিটেশন আছে, যা চাইলেই সমাধান সম্ভব নয় কিংবা নতুন করে হ্যাচারি বাড়ানো সম্ভব নয়। তবে মিরসরাইয়ের বন্ধ হয়ে যাওয়া হ্যাচারিটি আবার চালু করার কাজ চলছে।’
প্রসঙ্গত, জেলা মৎস্য দপ্তরের তথ্য মতে, চট্টগ্রামে মাছের চাহিদা ১ লাখ ১১ হাজার ১৯৮ দশমিক ৭৮ মেট্রিক টন। এর মধ্যে বদ্ধ ও মুক্ত জলাশয়ে চলতি বছরে মাছ উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ১১৮ দশমিক ৮২ মেট্রিক টন। মোট মাছ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫২ হাজার ৯২০ মেট্রিক টন।