নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন মঙ্গলী রানী। দুই মেয়ে ও শাশুড়িকে নিয়ে থাকতেন ফতুল্লার শিয়াচরে একটি ভাড়া বাসায়। তাদের গ্রামের বাড়ি সিলেটের ছাতকে। অসুস্থ স্বামীর মৃত্যুর পর জীবিকার খোঁজে বড় মেয়ে পূর্ণিমাকে নিয়ে এক বছর আগে ফতুল্লায় আসেন মঙ্গলী।
পূর্ণিমাকে নিয়েই শুক্রবার সকালে হেঁটে পূর্ব শিয়াচর এলাকায় একটি বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। সেই বাড়ির নিচতলায় হঠাৎ বিস্ফোরণ হয়, দেয়াল ধসে পড়ে তাদের ওপর। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে মৃত্যু হয় মঙ্গলীর। আর ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ওই বাড়ি সংলগ্ন ঘরে ভাড়া থাকা আরেক পোশাকশ্রমিক মায়া রানীর।
মায়ের মরদেহ মর্গে রেখেই দুপুরে বাড়ি ফেরে ১১ বছরের পূর্ণিমা। নিউজবাংলাকে বলে, ‘রাস্তা দিয়ে হাইট্টা যাওয়ার সময় ওই বিল্ডিংটা ফাইট্টা দেয়াল আইয়া মায়ের উপরে পড়ছে। আমার মাথায় ও পায়ে পড়ছে। এরপর আর কিছু জানি না। পরে আমারে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসছে। তয় টাকার লেইগা আমার পা বেন্ডিস করতে পারে নাই, খালায় (প্রতিবেশী) কইছে পড়ে করব।’
পূর্ণিমা জানায়, বাবার মৃত্যুর পর মা-ই সংসারের হাল ধরেন। ফতুল্লায় পোশাক কারখানায় কাজ নেন তিনি। পূর্ণিমা স্থানীয় একটি স্কুল ভর্তি হয়েছিল। দুই মাস আগে বাড়ি থেকে তার ছোট বোন ৬ বছরের স্বর্ণিমাকে নিয়ে দাদিও তাদের সঙ্গে থাকতে চলে আসেন। চারজনের সংসার সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন মঙ্গলী। সংসারের খরচ জোগাতে স্কুল ছেড়ে মায়ের সঙ্গে সেও পোশাক কারখানায় কাজে যোগ দেয়।
মঙ্গলী রানীর ছোট মেয়েকে জড়িয়ে বসে আছেন তার শোকাচ্ছন্ন শাশুড়ি
সে জানায়, তার জন্ডিস হয়েছিল কিছুদিন আগে। প্রতিবেশীদের পরামর্শে এক কবিরাজের কাছে চিকিৎসা নিচ্ছিল। সেই কবিরাজের কাছে যেতেই শুক্রবার সকালে মায়ের সঙ্গে বের হয় সে। পথে মাকে হারিয়ে ফেলে চিরতরে।
মাহারা পূর্ণিমার চোখে এখন অন্ধকার। বৃদ্ধ দাদি ও ছোট বোনকে কীভাবে সামলাবে, সংসারইবা কীভাবে চলবে, সে চিন্তায় যেন শোকও ভুলে গেছে ছোট্ট মেয়েটি।
শোকাচ্ছন্ন মায়া রানীর পরিবারও। মাকে হারিয়ে বেসামাল ১৩ বছরের বৃষ্টি। সাত বছরের ছোট্ট বোনকে জড়িয়ে সান্ত্বনাও দিচ্ছে, আবার ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে। কিছু দূরে নির্বাক বসে বাবা অখির্ত দাস।
নিউজবাংলাকে বৃষ্টি জানায়, শুক্রবার সকালে তারা ঘুমিয়ে ছিল। বিকট শব্দে ঘুম ভাঙলে দেখে ঘরের এক পাশে আগুন; দেয়াল ভেঙে তার বাবা-মায়ের ওপর পড়ে আছে।
বৃষ্টি বলে, ‘বাবায় মায়ের উপর থেকে দেয়াল সরাইয়া তারে বাঁচানোর চেষ্টা করতাছে। তহন বাবায় আমারে কয় বাইরে যাইতে। এরপর লোকজন আইসা মারে বাইর করছে। ততক্ষণে আমার মায় মইরা গেছে।’
বিস্ফোরণের এ ঘটনায় ৮ জন দগ্ধ ও আহত হয়েছেন। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মায়ের মরদেহের পাশে বসে হতবাক দুই শিশু
প্রত্যক্ষদর্শীরা ও আহতরা জানান, সকাল ৭টার দিকে পাঁচতলা ওই ভবনের নিচতলার ফ্ল্যাটে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। এতে পাশের আরও দুটি বাড়ি ও দোকানপাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ওই বাড়ির নিচতলা ও পাশের বাড়িতে যারা থাকতেন, তারা বিভিন্ন পোশাক কারখানায় কাজ করতেন বলে জানান স্থানীয়রা। আহতরা সবাই ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন।
ওই ভবনের দ্বিতীয় তলায় থাকেন সুজন মিয়া। তিনি বলেন, ‘নিচতলা থেকে অনেক শব্দ পেয়ে নেমে দেখি আগুন আর ধোঁয়া। বড় দেয়াল চারপাশে পড়ে আছে। সেখানে দেয়ালের নিচ থেকে একজন উদ্ধার করতে গেলে জানালা ভেঙে হাতের ওপর পড়ে। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে সবাইকে হাসপাতালে পাঠায়।’
উদ্ধারকাজ শেষে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দিনমনি শর্মা নিউজবাংলাকে জানান, ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণের পর আগুন লেগে যায়। ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করে। ধারণা করা হচ্ছে, নিচতলার ফ্ল্যাটে জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত চলছে।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ স্থানীয় রফিক মিয়া। তিনি বলেন, ‘কিছুদিন পরপর গ্যাসলাইনের বিস্ফোরণ হচ্ছে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায়। অথচ এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা তেমন কোনো ব্যবস্থা নেন না। ঘটনাগুলোতে যাদের স্বজন মারা যাচ্ছে, তারাই জানে পরিবারের লোক হারানো কত কষ্টের। এখানে যারা মারা গেছেন তারা অত্যন্ত গরিব পরিবারের সদস্য। ওই পরিবারগুলো এখন অচল হয়ে পড়বে।’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘বিস্ফোরণের ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রহিমা খাতুনকে প্রধান করে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
‘নিহতদের পরিবারকে শেষকৃত্যের জন্য ২০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে ভবনটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে।’