নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ২১টি পদের ১৪টিই ফাঁকা। আর সিনিয়র স্টাফ নার্সের ৩০টি পদের মধ্যে আছেন মাত্র চারজন।
অন্যান্য পদ মিলে মোট ৫৫টি পদের ৪৩টিই খালি পড়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। এ অবস্থায় জনবল সংকটে দ্বীপ উপজেলাটির জনস্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
হাসপাতালের জুনিয়র কনসালটেন্ট কার্ডিওলজি, গাইনি, মেডিসিন, সার্জারি, চক্ষু, চর্ম ও যৌন, নাক-কান-গলা, অর্থোপেডিক্স, মেডিক্যাল অফিসার হোমিও, ইএমও, আইএমও, এনেসথেশিস্ট, এমও প্যাথলজিস্ট, সহকারী ডেন্টাল সার্জন পদে কোনো চিকিৎসক নেই। চারটি মিডওয়াইফ পদের তিনটিই ফাঁকা।
মাত্র দুজন মেডিক্যাল অফিসার (স্যাকমো), একজন জুনিয়র কলসালটেন্ট (শিশু), একজন মেডিক্যাল অফিসার ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দিয়ে চলছে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম। জরুরি বিভাগ দেখেন মেডিক্যাল অফিসাররা।
এদিকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে জনবল সংকটের এই বাস্তবতায় আরেকটি সমস্যা হলো, হাতেগোনা যে কয়েকজন চিকিৎসক আছেন তারাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। হাসপাতাল চলার সময়েই তারা প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, খোদ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন কর্মস্থল বাদ দিয়ে একটি ল্যাবে নিয়মিত রোগী দেখেন। গত তিন মাস হাসপাতালে না এসে বাসা ও প্রাইভেট ক্লিনিকে তিনি রোগী দেখেছেন।
সম্প্রতি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শাহজাহানের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত উপজেলার উছখালী বাজারে তিনটি ল্যাব ও একটি ফার্মেসিতে অভিযান চালায়। এ সময় লাইসেন্স, সেবার মূল্য প্রদর্শন, ল্যাবে এক্স-রে কক্ষে সুরক্ষিত দরোজা না থাকাসহ বিভিন্ন অপরাধে চারটি প্রতিষ্ঠানকে মোট ৫৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
ভুক্তভোগীদের একজন হাতিয়ার বুড়িরচর এলাকার সুলতান আহমেদ নিউজবাংলাকে জানান, চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে গেলে কোনো চিকিৎসক পাওয়া যায় না। অথচ প্রাইভেট ক্লিনিকে গেলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকরাই টাকার বিনিময়ে সেবা দেন। কিন্তু প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য তাদের নেই।
ডা. নাজিম উদ্দিন এ ব্যাপারে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অবসর সময়ে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখি। এতে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগীদের সেবা কার্যক্রমে কোনো সমস্যা হওয়ার তো কথা নয়।’
সরেজমিনে দেখা যায়, ৫০ শয্যার হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি দ্বীপের ছয় লাখ মানুষের চিকিৎসায় একমাত্র ভরসা। কিন্তু প্রসূতি, শিশুরোগসহ নানা অসুস্থতায় আক্রান্ত মানুষ এখানে চিকিৎসা নিতে এসে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আসা রোগীরা না পাচ্ছেন ডাক্তার, না পাচ্ছেন ভর্তি হওয়ার সুযোগ। হাসপাতালের বারান্দা ও করিডোরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে রোগীদের। তারপরও চিকিৎসকের অভাবে চিকিৎসা পাচ্ছে না তারা।
হাতিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী ডেন্টাল সার্জন এবং এমও প্যাথলজিস্ট দীর্ঘদিন ধরে অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন। অথচ বেতন নিচ্ছেন হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে।
উপজেলার ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেও চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা সেবা। হরনী ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র ছাড়া চিকিৎসকবিহীন রয়েছে চানন্দী ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, নলচিরা উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বুড়িরচর ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, সোনাদিয়া ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র, আফাজিয়া ইউনিয়ন উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ওছখালি উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র।
এ বিষয়ে নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘নার্সিং এন্ড মিডওয়াইফারী অধিদপ্তর থেকে নার্স ও মিডওয়াইফ পদে উপজেলা পর্যায়ে নিয়োগ পেয়ে এলেও কিছুদিনের মধ্যে কীভাবে যেন তারা আবার চলে যায়।’
‘আমরা হাতিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এখানে চিকিৎসক সংকটের কথা সিভিল সার্জন অফিসে বার বার জানিয়েছি। এর মধ্যে তিনজন এমবিবিএস ডেপুটেশনে পাঠানো হয়েছে।’
নোয়াখালীর সিভিল সার্জন মাসুম ইফতেখার বলেন, ‘ওই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার-নার্স সংকটের বিষয়ে আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে বার বার লিখেছি। হাতিয়ায় রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে জেলার কোভিড হাসপাতাল থেকে দুইজন এবং সোনাইমুড়ী থেকে একজন ডাক্তার পাঠিয়েছি। আর নার্স সংকট দূর করতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। নতুন নার্স নিয়োগ করা হলে হাতিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে।’
উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি দ্বীপ এলাকায় হওয়ায় সেখানে নিয়মিত মনিটরিং করা কষ্টকর। তারপরও বিষয়টি আমি অবগত হয়ে তাকে সাবধান করে দিয়েছি। ভবিষ্যতে এমনটি হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’