ডিজেলের দাম ২৩ শতাংশ বাড়ানোর পর এই জ্বালানিতে চালিত বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়ানো হলেও অতিরিক্ত ভাড়া নিচ্ছে সিএনজিচালিত বাসও। কোনো কোনো রুটে নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ ভাড়া।
সোমবার সকালে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে দেখা গেছে, বেশির ভাগ চালক ও হেল্পারই দাবি করছেন তাদের বাস ডিজেলচালিত। এই অজুহাত দিয়ে নেয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া।
মিরপুর-সদরঘাট রুটে প্রায় সব বাসেই নেয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। এই রুটের বিহঙ্গ পরিবহন এত দিন সিএনজিচালিত বাস বলে সবার জানা থাকলেও চালক ও হেল্পাররা দাবি করছেন তাদের বাস ডিজেলচালিত। নেয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া।
একটি বিহঙ্গ বাসের কন্ডাক্টর ইকবাল শেখ নিউজবাংলাকে জানান, তাকে বিহঙ্গ পরিবহন মালিকরা এভাবেই ভাড়া তুলতে নির্দেশনা দিয়েছেন। মিরপুর থেকে সদরঘাটের বাস ভাড়া ছিল ৩০ টাকা, এখন নেয়া হচ্ছে ৪৫ টাকা।
বিআরটিএ ঢাকা শহরে বাস ভাড়া ২৬ দশমিক ৫০ শতাংশ বাড়ানোয় সে হিসাবে মিরপুর-সদরঘাট রুটে পুনর্নির্ধারিত ভাড়া হতে পারে ৩৫ টাকা। যাত্রীদের এমন প্রশ্নে কান দিচ্ছেন না চালক-কন্ডাক্টররা।
সদরঘাটগামী যাত্রী শাকিল হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, প্রতি লিটার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ১৫ টাকা অথচ প্রতি যাত্রীর কাছ থেকে তারা আদায় করছে ১৫ টাকা বেশি। এসব কে দেখবে? আমাদের মতো সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষের মরণ ছাড়া কোনো রাস্তা খোলা নাই।’
একযাত্রী বলেন, বিহঙ্গ বাস তো এত দিন সিএনজিচালিত ছিল। জবাবে ড্রাইভার বলেন, ‘ট্যাংকি খুলে দেখেন, আমাদের বাস সিএনজিতে চলে, নাকি ডিজেলে চলে।’
ঢাকা জজকোর্টের আইনজীবী ফারুক আহমেদ চিৎকার করে কন্ডাক্টরকে বলেন, ‘এক টাকাও ভাড়া বেশি দেব না।’
অনেক তর্কাতর্কির পর ৫ টাকা কম দিয়ে ৪০ টাকা ভাড়া দিতে সক্ষম হন ওই আইনজীবী।
আরও কয়েকজন যাত্রীর কাছে ৩০ টাকার জায়গায় ১৫ টাকা ভাড়া বেশি চাওয়ায় তুমুল হট্টগোল শুরু হয় বাসে। মিরপুর রোকেয়া সরণির তালতলা থেকে শুরু হয়ে পুরান ঢাকার সদরঘাট পর্যন্ত চলতে থাকে যাত্রী-কন্ডাক্টরের বাতচিত।
হাতিরঝিল চক্রাকার বাসের বেশির ভাগই সিএনজিচালিত। এর পরও বাড়ানো হয়েছে ভাড়া। প্রতিটি পয়েন্টে ভাড়া বেড়েছে ৫ টাকা।
মেরুল বাড্ডা বাস কাউন্টার থেকে এফডিসি কাউন্টার পর্যন্ত আগে ১৫ টাকা ভাড়া থাকলেও এখন সেটি ২০ টাকা করা হয়েছে। মেরুল বাড্ডা বাস কাউন্টার থেকে পুরা হাতিরঝিল ঘুরে এলে গুনতে হচ্ছে ৪০ টাকা। আগে লাগত ৩০ টাকা।
আশপাশের রুটের অন্যান্য বাসেও বাড়ানো হয়েছে ভাড়া।
মিরপুর-১০-এর বাসিন্দা আক্কাস আলীকে চাকরির কারণে সপ্তাহে ছয় দিন রামপুরা আসতে হয়। প্রতিদিনের মতো সোমবার সকালে তিনি নূরে মক্কা পরিবহনে উঠেছেন। অন্যদিন ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে রামপুরা পর্যন্ত আসতে পারলেও এদিন ৫ টাকা বেশি দিয়ে আসতে হয়েছে।
আক্কাস জানালেন, ভাড়া বেশি দিতে না চাইলে আক্কাস আলীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এ সময় সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা-কাটাকাটিও হয়।
রাজধানীর আফতাব নগর ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান প্রতিদিনের মতো উত্তর বাড্ডা থেকে আফতাব নগর আসতে আগের ভাড়া ১০ টাকার স্থলে দিতে হচ্ছে ১৫ টাকা।
ওই শিক্ষার্থী বলেন, ‘উত্তর বাড্ডা থেকে আফতাবনগর দুই কিলোমিটার রাস্তা, যে ভাড়া বেড়েছে সেই ভাড়া আমার কাছ থেকে নিয়ে নিয়েছে। অন্যদের কাছ থেকে যে টাকা নেবে সেটি সবই লাভ।’
প্রতিবাদ করেননি কেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৫ টাকার জন্য কী সুপারভাইজারের সঙ্গে ঝগড়া করব। বাসের মধ্যে অনেকের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়েছিল।’
মগবাজার মোড়ে দেখা হয় বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা মারুফ রশিদের সঙ্গে। তিনি মহাখালী থেকে গাজীপুর পরিবহনে মগবাজার মোড়ে এসেছেন।
বাস ভাড়া কত নিল, কত টাকা বেশি নিল? এমন প্রশ্ন করতেই তার কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে। বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল আর গণপরিবহন বন্ধ হয়ে গেল। ভাড়া বাড়ল, আর এমনিতেই বাস চালু। কী সার্কাস, কী তামাশা।’
প্রতিদিনের চেয়ে আজ কত টাকা ভাড়া বেশি নিল- এমন প্রশ্নে মারুফ বলেন, ‘সাধারণত মহাখালী থেকে মগবাজার পর্যন্ত এত দিন ভাড়া ছিল ১০ টাকা। আজ নিল ১৫ টাকা। এক লাফে ৫ টাকা বেশি নিল।’
একই সুরে কথা বললেন ব্যবসায়ী মোখলেসুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ভাড়া বাড়ানোই যদি সমাধান হয় তাহলে দুই দিন কেন আমাদের ভোগান্তি পোহাতে হলো। দেশে কি সরকার বলে কিছু নেই?’
তিনি আরও বলেন, ‘পত্রিকায় দেখলাম ভারত তেলের দাম কমাচ্ছে, আমাদের এখানে বাড়াচ্ছে। এ দেশে সব বাড়ে; তেলের দাম, চালের দাম, পানির দাম, গ্যাসের দাম, শুধু কমে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা।’
আজ কত টাকা বাড়তি ভাড়া দিতে হলো- এমন প্রশ্নে মোখলেসুর বলেন, ‘আমার বাসা মোহাম্মহদপুর। প্রতিদিন মোহাম্মদপুর থেকে স্বাধীন পরিবহনে আসি। ভাড়া নেয় ২০ টাকা। আজ নিল ৩০ টাকা। হেলপারকে বললাম এত ভাড়া কেন? হেলপার জবাব দিল সরকার বাড়াইছে।’
রাজধানীর উপকণ্ঠ সাভারের হেমায়েতপুর থেকে বাড্ডা লিংক রোডগামী বৈশাখী পরিবহনের বাসের যাত্রী আরিফ হোসেন (ছদ্মনাম) বলেন, ‘বাস চলছে স্বাভাবিক সময়ের মতোই, তবে ভাড়া বেশি রাখা হচ্ছে।’
আরিফ জানান, হেমায়েতপুর থেকে লিংক রোডের ভাড়া ৫০ টাকা রাখা হয়েছে। যদিও আগে এ ভাড়া ছিল ৪০ টাকা। সে হিসাবে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ২৫ শতাংশ।
ডিজেলচালিত বাসটির চালকের সহকারী ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘মামা দুয়েক দিন একটু বাড়ায়া রাখব। পরে সরকারের রেটেই রাখা হবে। নাইলে আপনি এক কথা কইবেন, হ্যায় আরেক কথা কইব।’
ফয়জুল্লাহর বক্তব্যের আগে ভাড়া নিয়ে চালকের সঙ্গে এক যাত্রীর বিতণ্ডা দেখা যায়। অবশ্য যাত্রীদের হস্তক্ষেপে সেটি বেশি দূর গড়ায়নি।