গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে উচ্ছেদ অভিযানের নামে সাঁওতাল পল্লিতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও তিন সাঁওতালকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটে ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর। ওই ঘটনায় হওয়া মামলার বিচার শুরু হয়নি পাঁচ বছরেও। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ সাঁওতাল নেতাসহ হতাহতদের পরিবার ও ক্ষতিগ্রস্তরা।
রংপুর চিনিকলের আওতাধীন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম এলাকার ইক্ষু খামারে সাঁওতাল ও বাঙালিদের বসতবাড়িতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী উচ্ছেদ অভিযান চালায় ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সকালে। বিনা নোটিশে ওই অভিযানের সময় জান-মাল রক্ষার্থে প্রতিরোধ গড়ে তোলে পল্লির বাসিন্দারা। বিক্ষুব্ধদের দমনে একপর্যায়ে পুলিশ তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়।
গুলিবিদ্ধ হয়ে শ্যামল হেমরম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু নামের তিন সাঁওতাল নিহত হন। আরও বেশ কয়েকজন সাঁওতাল-বাঙালি গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। এ ছাড়া পুলিশসহ উভয় পক্ষে কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়।
পল্লির বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীদের অভিযোগ, এই ঘটনার সময় পুলিশ-প্রশাসনের উপস্থিতিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও একাধিক জনপ্রতিনিধির প্রত্যক্ষ মদদে তাদের সাঙ্গোপাঙ্গরা এই হামলা ও লুটপাটে অংশ নেয়। গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ, সাপমারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাকিল আকন্দ বুলবুল, রংপুর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল আউয়াল, ইউএনও আব্দুল হান্নান, থানার ওসি সুব্রত কুমার সরকার ও কাঁটাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিকসহ অনেকেই পুরো ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
এরপর সাঁওতাল পল্লির বাড়িঘরে পুলিশ প্রশাসনের আগুন দেয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলেও পাঁচ বছরেও আলোচিত এই মামলার বিচারকাজ শুরু হয়নি।
পুলিশ প্রশাসনের উপস্থিতিতে হামলার অভিযোগ করেন সাঁওতাল পল্লির বাসিন্দারা
মামলার গতিপ্রকৃতি
৬ নভেম্বরের ওই ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষ থেকে থমাস হেমরম বাদী হয়ে তৎকালীন গাইবান্ধা-৪ (গোবিন্দগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদ ও চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল আউয়ালসহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করে মামলা করেন। মামলাটি পরবর্তী সময়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত।
তদন্ত শেষে ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই পিবিআই মূল আসামিদের বাদ দিয়ে ৯০ জনের নাম উল্লেখ করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এরপর ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর চার্জশিট প্রত্যাখ্যান করে না-রাজি করে বাদীপক্ষ। পরে একই বছরের ২৩ ডিসেম্বর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেয় আদালত।
সিআইডি তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ২ নভেম্বর গোবিন্দগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৪৯৬ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র জমা দেয়। মামলার মূল আসামিদের নাম বাদ দিয়ে চার্জশিট দেয়ার অভিযোগ তুলে সেটিও প্রত্যাখ্যান করে বাদীপক্ষ। পরে চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি আবারও এর বিরুদ্ধে না-রাজি দেন বাদী।
বাদীর সর্বশেষ না-রাজি পিটিশনের পর মামলাটির ওপর গত ১২ অক্টোবর আদালতে শুনানি ও আলোচনা হয়। শুনানি শেষে আগামী ৭ ডিসেম্বর আদেশের দিন ধার্য করে আদালত।
আবারও বাস্তুচ্যুত হওয়ার শঙ্কা, উত্তাপ
৬ নভেম্বরের ওই ঘটনার পর চিনিকলের এক হাজার ৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি পুরোটাই দখলে নেয় সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। এরপর দীর্ঘদিন এ নিয়ে আলোচনা ছিল না। পরবর্তী সময়ে কিছু জমিতে অবশ্য কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এই জনগোষ্ঠীর যাতায়াত বন্ধ করে দেয় মিল কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ২০১৯ সালে সরকারের এক সিদ্ধান্তে বন্ধ হয়ে যায় রংপুর চিনিকলসহ দেশের বেশ কয়েকটি চিনিকল। তখন থেকে সব জমি ভোগদখল করে আসছে সাঁওতাল-বাঙালিরা।
সম্প্রতি এই এলাকা নিয়ে ফের উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় দুই হাজার একরের এই জমিতে ইকোনমিক জোন করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর জমি পরিদর্শনসহ পরবর্তী কাজও শুরু করেছে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (বেপজা) কর্তৃপক্ষ।
এর পরই এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে সাঁওতালরা। এই জমি নিজেদের দাবি করে ফের আন্দোলনে নেমে সড়ক অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে তারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর স্মারকলিপিও দেয়া হয়েছে।
সরকারের বৃহত্তর এই পরিকল্পনা যেকোনো মূল্যে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে সাঁওতালরা। তাদের দাবি, ৬ নভেম্বর হামলা ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েও উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়ে সরকার নতুন করে ইপিজেড স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একটি মহল বেপজা কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করে সাঁওতাল-পল্লির তিন ফসলি জমিতে শিল্প-কারখানা স্থাপনের পাঁয়তারা করছে।
পল্লির জয়পুর গ্রামের ফুলমনি হেমরম বলেন, ‘এটা আমার বাপ-দাদার পৈতৃক জমি। সরকার এটা আমাদের ফিরত দিক। আমাদের সরিয়ে ইপিজেড হতি পারে না। করতি দিব না। জীবন দিব; জমি দিব না। আর ইপিজেড হতি দিব না।’
৬ নভেম্বর হামলার সময় গুলিতে পা হারানো পল্লির বিমল কিসকু বলেন, ‘সেই ১৮১৬ সাল থাকি আমরা এখানে বাস করছি। এই যে আমরা গুলিবিদ্ধ হইছি; আমরা কোনো অনুদান পাইনি। আমরা কি দেশের জনগণ না। আমরা কি ভুট (ভোট) দিই না।’
সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি বার্নাবাস টুডু বলেন, ‘আমাদের নানাভাবে নির্যাতন করা হইছে। পুলিশ নির্যাতন করছে। এলাকার প্রভাবশালীরা নির্যাতন করছে। গুলি করে তিন ভাইকে মারছে। আমাদের ঘরে আগুন লাগি দিছে। লুটপাট করছে। এখন আমাদের একেক জনের পিছে ৮ থাকি ৯টি করি মামলা ঢুকি দিছে।’
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক জাফরুল ইসলাম প্রধান বলেন, ‘প্রশাসন দিয়ে গুলি চালানোর পরও আসামিরা দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে। উল্টো আদিবাসীদের নামে একটার পর একটা মামলা দিচ্ছে।’
ইপিজেড নিয়ে এই সাঁওতাল নেতা বলেন, ‘আমরাও দেশের উন্নয়ন চাই। তবে নৃগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ আর নিঃস্ব করে সেই উন্নয়ন করাটা কতটা যৌক্তিক?’
স্থানীয় একটি পক্ষ অবশ্য বলছে, চিনিকলের জমিতে ইপিজেড হলে অসংখ্য শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে। সেখানে গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের দুই লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।
স্থানীয় প্রশাসনও ইপিজেড স্থাপনের পক্ষে। তারা বলছে, এই জমিতে ইপিজেড নির্মাণ সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ইপিজেড হলে এই অঞ্চলের শিক্ষিত ও বেকার যুবকরা চাকরির সুযোগ পাবে। শুধু গাইবান্ধা নয়, বৃহত্তর রংপুর বিভাগের কয়েকটি জেলা নানামুখী সুবিধা ভোগ করবে। জীবনমানে পরিবর্তন ঘটবে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীরও।
তবে সাঁওতালদের জমি ফেরতের এই আন্দোলন-সংগ্রামে একাত্মতা জানিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন। এসব সংগঠনের নেতারা সাঁওতাল পল্লিতে ইপিজেড বাতিল করে পলাশবাড়ী উপজেলার সাঁকোয়া ব্রিজ এলাকায় স্থানান্তরের দাবি তুলেছেন।
সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও বাংলাদেশ রবিদাস ফোরামসহ কয়েকটি রাজনৈতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। তাদের সঙ্গে রয়েছেন গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চ, সাকোয়াঁ ব্রিজ ইপিজেড বাস্তবায়ন মঞ্চ, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ, আদিবাসী ইউনিয়ন ও জন-উদ্যোগসহ বেশ কয়েকটি সংগঠন।আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক ও গাইবান্ধা নাগরিক মঞ্চের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, ‘সাঁওতাল পল্লিতে ইপিজেড স্থাপনের পরিকল্পনা বিস্ময়কর ঘটনা। পৈতৃক জমি থেকে আবারও সাঁওতালদের উচ্ছেদের চেষ্টা করাটা অযৌক্তিক বলে আমি মনে করি।’
‘সাঁওতাল হত্যা দিবস’
এদিকে হামলার ওই দিনটিকে প্রতিবছর ‘সাঁওতাল হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করছে পল্লির বাসিন্দারা। শনিবার পাঁচ বছর পূর্তিতে সেখানে শোকযাত্রা, পুষ্পস্তবক অর্পণ, মোমবাতি প্রজ্বালন, স্মরণসভা, সমাবেশসহ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।