১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা শহরে যখন পৃথিবীর প্রথম পারমাণবিক বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, সেই দিনটিতে সুনাও সুবোই ছিলেন ২০ বছরের তরতাজা যুবক। ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র।
সেদিন সুবোই যেখানে অবস্থান করছিলেন, তার এক মাইলেরও কম দূরত্বে বোমাটির বিস্ফোরণ ঘটে। তবু আশ্চর্যজনকভাবে বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি।
অনেকেই ভেবেছিলেন বিস্ফোরণে মারাত্মক আহত সুবোই হয়তো খুব বেশি দিন বাঁচবেন না। কিন্তু সবার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে তিনি আরও ৭৬ বছর বেঁচেছেন। গত ২৪ অক্টোবর ৯৬ বছর বয়সে তিনি পৃথিবী ছেড়ে গেছেন।
শুধু বেঁচে থাকাই নয়, দশকের পর দশকজুড়ে সেদিনের সেই ভয়াবহ বিস্ফোরণের গল্প বলে গেছেন বিশ্ববাসীকে। পারমাণবিক বোমার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে গেছেন মানবসভ্যতাকে।
৯ হাজার ৭০০ পাউন্ড ওজনের ইউরেনিয়াম বোমাটি বিস্ফোরণের তীব্রতায় মুহূর্তের মধ্যেই ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল হিরোশিমা শহর। বিস্ফোরণ মুহূর্তে একটি রুপালি আলোর ঝলকানিতে দূরে ছিটকে পড়েছিলেন সুবোই। পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণে মাশরুম আকৃতির যে ধোঁয়ার কুণ্ডলী সৃষ্টি হয়, তা মাথার ওপরেই দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। জ্ঞান ফেরার পর তিনি দেখতে পান, মাথা থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত তার সারা শরীর পুড়ে গেছে।
গত কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিস্ফোরণ-পরবর্তী সময়টিকে ‘পৃথিবীর বুকে নরক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন সুবোই। সেই সময়টিতে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন, আশপাশের কিছু মানুষ হাঁটার চেষ্টা করতে গিয়ে বারবারই পড়ে যাচ্ছিলেন। পরনের কাপড়চোপড় পুড়ে যাওয়ায় সবাই তখন উলঙ্গ। এর মধ্যে অনেকেরই হাত খসে গেছে, পা খসে গেছে।
আহত অবস্থায় সুবোইকে একটি মিলিটারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে সেখানেই তিনি ধীরে ধীরে সুস্থ হন। দীর্ঘদিন তার চলাফেরা করার উপায় ছিল না। সারা শরীর আর মুখমণ্ডল পুড়ে যাওয়ায় তার চেহারা ছিল বিকৃত।
১৯২৫ সালের ৫ মে হিরোশিমার কাছাকাছি লোকালয় ওনডোতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সুবোই। সেখানেই বেড়ে ওঠেন। ১৯৪৩ সালে হিরোশিমার একটি প্রযুক্তি বিষয়ক কলেজে পড়াশোনা শুরু করেন। এই কলেজ এখন হিরোশিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত।
বিস্ফোরণের পর সুস্থ হয়ে গণিত শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন তিনি। আর প্রেমে পড়েছিলেন তার সাবেক শিক্ষার্থী সুজুকো এনোকির। কিন্তু সুজুকোর পরিবার এই সম্পর্ককে মেনে নিতে চায়নি। কারণ তারা ভেবেছিলেন, পারমাণবিক বোমার প্রতিক্রিয়ায় সুবোই হয়তো বেশি দিন বাঁচবেন না।
প্রেম পরিপূর্ণতা না পাওয়ার দুঃখে ঘুমের ওষুধ খেয়ে একসঙ্গে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান সুবোই আর সুজুকো। ভাগ্যক্রমে তারা সেদিন বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে তাদের এমন প্রবণতা দেখে সুজুকোর পরিবার শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটিকে মেনে নেয়। ১৯৫৭ সালে এই জুটি বিয়ে করেন।
জীবদ্দশায় প্রতিবছর ৬ আগস্ট দিনটিকে অন্যরকমভাবে উদযাপন করতেন সুবোই। গণিতের ক্লাসে সেই দিনটিতে শিক্ষার্থীদের কাছে অতীতের ভয়াবহ দিনটির স্মৃতিচারণা করতেন।
১৯৯৩ সালে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসর নিয়ে তিনি পৃথিবী ঘুরতে শুরু করেন। পৃথিবীর ঘুরে ঘুরে তিনি মানুষের কাছে হিরোশিমার সেই দুঃসহ দিনের গল্প বলতেন। আর পারমাণবিক বোমার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতেন।
ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় প্রথম ও একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে বারাক ওবামা জাপানের হিরোশিমা সফর করেছিলেন। সে সময় তিনি সুবোইয়ের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। সেদিনই ওবামা পারমাণবিক বোমার বিরুদ্ধে একটি ‘নৈতিক বিপ্লব’ শুরু করার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন।