‘খাইয়া, না খাইয়া গুড়াগাড়া লইয়া ২২টা দিন কাডাই দিছি। অবরোধ শ্যাষ অওয়ার লগে লগে নাও আর জাল লইয়া গাঙ্গে নাইম্মা ৩০ কেজির মতো মাছ পাইছিলাম। বেইচ্চা বাড়িতে চাইল-ডাইল কিন্না আনছি। পরের দিন দুই ফির খ্যাও দিয়া মাছ পাইচি ৬ কেজি। এহন আর গাঙ্গে ইলিশ পাই না। এত ইলিশ আচুক্কা (হঠাৎ) কোম্মে উধাও অইয়া গ্যাছে!’
এমন প্রশ্ন কেবল মৎস্যজীবী কালুর নয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিষখালী, বলেশ্বর ও পায়রা তিন নদীতীরবর্তী প্রায় ৪০ হাজার জেলের মনেই এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। অবরোধ শেষে জাল নিয়ে নদীতে নেমে তারা ইলিশের দেখা পাচ্ছে না তারা।
গত ৪ অক্টোবর থেকে টানা ২২ দিন প্রজনন মৌসুমে ইলিশ শিকার বন্ধ ছিল। অবরোধ শেষে ২৬ অক্টোবর আটঘাট বেঁধে নদীতে ইলিশ শিকারে নামে জেলেরা। তবে শুরুর এক দিনই কেবল বরগুনার নদ-নদীতে ইলিশ ধরা পড়েছে। এরপর থেকে আর ইলিশের দেখা মিলছে না। এতে যারপরনাই হতাশ উপকূলের প্রান্তিক জেলেরা। জেলেরা বলছে, এবার মৌসুমজুড়েই বরগুনার নদ-নদীতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়েনি।
মৎস্য বিভাগের পরিসংখ্যানের সঙ্গে জেলেদের বক্তব্য মিলে যায়। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, এবার মৌসুমের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এখানে মোট এক হাজার ২১৯ দশমিক ৪০ টন ইলিশ উঠেছে। এই পরিমাণ গত ১০ বছরের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। আগের বছর পাথরঘাটায় অবতরণ হয় মাত্র এক হাজার ১১ দশমিক ২০ টন ইলিশ।
বিএফডিসি পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, ২০১০-১১ থেকে ২০১৬-১৭ মৌসুম পর্যন্ত পাঁচ বছরে এই কেন্দ্রে মোট ১৭ হাজার ৭৬৫ টন ইলিশ নামানো হয়। অথচ ২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২০২১ মৌসুমের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পাঁচ বছরে মোট ইলিশ নামে ১১ হাজার ৩০৭ টন। সে হিসাবে শেষ পাঁচ বছরে এখানে ছয় হাজার ৪৫৮ টন ইলিশ কম অবতরণ হয়েছে। অর্থাৎ গত পাঁচ বছরে ইলিশের অবতরণ এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে।
জেলে ও ট্রলার মালিকসহ সংশ্লিষ্ট অন্যরা বলছেন, গত দুই বছরে ইলিশের অবতরণ কম হওয়ার প্রধান কারণ সাগর মোহনায় ডুবোচর ও অবৈধ বেহুন্দি জালের বিস্তার। ৩০ বছর ধরে সাগরে ইলিশ শিকার করছেন পাথরঘাটার ট্রলার মালিক আব্বাস মিয়া। তিনি বলেন, ‘মোহনায় ডুবা চর জাইগা এমন অবস্থা অইছে যে ইলিশ যে এইহানে ডিম পাড়তে আসবে হেইয়া পারতে আছে না। চরের লাইগা বাধা পাইয়া মাছ ফিররা যায়। হেইয়ার কারণে মোরা এইহানে ইলিশ মাছ পাইতেছি না।’
বাংলাদেশ ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি পাথরঘাটার মোস্তফা চৌধুরী বলেন, মৌসুমে পাথরঘাটা থেকে গড়ে প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার ট্রলার সাগরে ইলিশ শিকারে যায়। কিন্তু দুই বছর ধরে আমরা কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাই না। এর অন্যতম কারণ, প্রজননস্থলে ইলিশের অবাধ বিচরণের পরিবেশ নেই। বিশেষ করে বিষখালী, বলেশ্বর ও পায়রা নদীর মোহনায় অসংখ্য ডুবোচর জেগেছে। এতে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ইলিশ গতিপথ পরিবর্তন করে মেঘনা ও পদ্মার দিকে চলে যাচ্ছে। এ বছর পদ্মা-মেঘনায় ইলিশ ধরা পড়েছে। অবরোধের পরও সেখানে ইলিশ পাওয়া যায়। কিন্তু এখানে নদীতে ইলিশ নেই।
মহিপুর মৎস্য আড়ত সমবায় সমিতির সভাপতি দিদার উদ্দিন আহমেদ মাসুম ব্যাপারী বলেন, গত বছর থেকে ইলিশের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। মহিপুর, আলীপুর ও কুয়াকাটার ১৮৯টি আড়তে মৌসুমে শত শত মণ ইলিশ আসত। সেখানকার ব্যবসায়ীদেরও এখন মাথায় হাত। কোটি কোটি টাকা লগ্নি করেও তারা লাভের মুখ দেখতে পারছে না।
আলীপুর-কুয়াকাটা মৎস্য আড়ত সমবায় সমিতির সভাপতি আনছার উদ্দিন মোল্লা বলেন, সর্বশেষ অবরোধের আগে মাত্র চার দিন ইলিশ ধরা পড়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জেলেরা এখানে ইলিশ বিক্রি করতে আসে। তবে সেসবের বেশির ভাগই সাগরের। নদীতে ইলিশ নেই বললেই চলে।
গবেষকরা বলছেন, ইলিশের জন্য মোহনা এখন আর নিরাপদ নয়। নাব্য সংকট, নিষিদ্ধ জালের অধিক ব্যবহার এবং অতি আহরণে ইলিশের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলেন, ‘নাব্য সংকটই প্রধান কারণ। এর বাইরে কিছু কিছু জায়গায় দূষণও আছে। এসব কারণে নদ-নদীতে সেভাবে ইলিশ আসছে না। মেইন স্ট্রিম ঠিক রাখা, নদীর স্রোত ঠিক রাখা অর্থাৎ সেখানে ইলিশের ইচ্ছামাফিক অবাধ চলাচলের পথ রাখার দিকে জরুরি ভিত্তিতে দৃষ্টি দিতে হবে। তাতে ইলিশের পাশাপাশি অন্যান্য মাছের উৎপাদনও বাড়বে।’