বছরের শুরুটাই হয়েছিল জীবনযাত্রার ব্যয়ে ঊর্ধ্বগতি দিয়ে। এরপর দিন যত এগিয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও সেবার দাম বেড়েছে। ৮৫ থেকে ১০৫ টাকার সয়াবিন তেলের দাম কয়েক দফায় বাড়িয়ে প্রতি লিটার ১৬০ টাকায় নেয়া হয়। ৪০-৪৫ টাকার পেঁয়াজ ঠেকেছে ৮০ টাকায়। এই সময়ে থেমে ছিল না জীবনধারণে অন্যান্য পণ্য ও সেবার দাম বৃদ্ধিও।
এমন পরিস্থিতিতে ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও কেরোসিনে দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দিল সরকার। অর্থাৎ তেলের দাম প্রতি লিটারে ২৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে ১২ কেজির সিলিন্ডারের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম দুই দফায় ২৮০ টাকা বাড়ানো হয়।
অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণকারী সংগঠনগুলোর দাবি, জ্বালানি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে বাড়বে পরিবহণ ব্যয় ও পণ্যের উৎপাদন খরচ। তবে এতে উদ্যোক্তা বা পরিবহণ মালিকদের কোনো ক্ষতি হবে না। তারা দাম বাড়িয়ে নিজেদের খরচ ঠিকই সমন্বয় করে নেবেন। ফলে শেষ পর্যন্ত জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির খেসারত সাধারণ মানুষ কিংবা ক্রেতা-ভোক্তাকেই দিতে হবে। তাদেরকে আনুপাতিক হারের চেয়েও বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে এবং সেবা নিতে হবে, যা আসলে জীবনযাত্রার ব্যয় অত্যধিক বৃদ্ধি ঘটাবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকারী বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ নিউজবাংলাকে জানান, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। এর ফলে দেশে দেশে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করা হচ্ছে। বাংলাদেশও দাম সমন্বয় করছে। এই দাম সমন্বয়ের প্রভাব শুধু পণ্যমূল্যে নয়, আরও যেখানে যেখানে পড়ার কথা, পড়বে।’
জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির প্রভাব এরই মধ্যে পড়তে শুরু করেছে। ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে অনেক জেলায় বন্ধ করা হয়ে পরিবহন চলাচল
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে দেশে বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ক্যাব) বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী, দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং বিভিন্ন পণ্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য বেড়েছে ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ।
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির এই হার ২০১৯ সালে ছিল ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং পণ্য ও সেবামূল্য বৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে এই বৃদ্ধির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক শূন্য শতাংশ ও ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ। এর মানে গত তিন বছর ধরে দেশে জীবনযাত্রার ব্যয় ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা চলতি বছর (২০২১ সাল) আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির হালনাগাদ প্রতিবেদন মতে, চলতি অর্থবছরের তৃতীয় মাস সেপ্টেম্বরে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ, যা আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ৫৪ শতাংশ। এই সময় খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ, যা আগস্টে ছিল ৫ দশমিক ১৬ শতাংশ। এ ছাড়া খাদ্য বর্হিভূত পণ্যেও মূল্যস্ফীতিও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ১৯ শতাংশে, যা তার আগের মাসে ছিল ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ।
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন ছড়াবে বলে আশঙ্কা করছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
এ প্রসঙ্গে ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান নিউজবাংলাকে জানান, ‘ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য বৃদ্ধির কারণে পণ্য পরিবহন ও যাতায়াত খাতে ব্যয় বাড়া ছাড়াও প্রতিটি পণ্য ও সেবার দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনজীবনে মারাত্মক দুর্ভোগ সৃষ্টি করবে।’
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চাল, চিনি, সবজির দামের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকায় নাভিশ্বাস উঠেছে। এর সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হলো জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি। গ্যাস, বিদ্যুৎ পানির মূল্যও দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে। বেড়েছে ডলারের দামও। কয়েকদিন আগে সীমিত আয়ের মানুষের ভরসাস্থল টিসিবির পণ্যের দামও বাড়ানো হয়েছে।
‘এ অবস্থায় কেরোসিন এবং ডিজেলের দাম বাড়ানো ভোক্তা পর্যায়ে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’
এ বিষয়ে বাংলাদেশ রিভার ট্রান্সপোর্ট এজেন্ট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রকিবুল আলম দিপু নিউজবাংলাকে জানান, ‘আমরা যারা কার্গো ভেসেলের ব্যবসা করি, এর মূল কস্ট মানে জাহাজের ব্যবসার দুই-তৃতীয়াংশ খরচ হচ্ছে জ্বালানি। এই জ্বালানি যদি হঠাৎ করে ১৫ টাকা লিটারে বেড়ে যায়, মানে ৬৫ টাকারটা ৮০ টাকা, এ মূল্য বৃদ্ধি শুধু কার্গো ব্যবসায়ীদের ওপর না, সারা দেশের সব ধরনের পণ্য পরিবহনের ওপর পড়বে। পরিবহন ভাড়া বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে। আর তার পুরো ভার ভোক্তাকে বা ক্রেতাকেই বহন করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি আমার ভাড়া বাড়িয়ে দেব। সমন্বয় করে নেব। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা কিন্তু ভোক্তারই হবে।’
এ বিষয়ে বাস মালিক সমিতির মহাসচিব এনায়েত উল্যাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জ্বালানির দাম বাড়ায় আমরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত। সিদ্ধান্ত কার্যকরের ফলে আমাদের জ্বালানি বাবদ ব্যয় বাড়বে। এ বাড়তি ব্যয় সমন্বয় করতে হলে আমাদের পরিবহণ ভাড়া বৃদ্ধি ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি হ্রাসের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে এর প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা দুর্বিসহ হয়ে উঠবে, যা ভয়াবহ হতে পারে। তবে বিগত দিনগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও বাংলাদেশের বাজারে তার প্রতিফলন ঘটেনি।
ক্যাব জানিয়েছে, সরকার সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার সঙ্গে যুক্ত ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম বাড়ালেও অকটেন ও পেট্রোলের দাম বাড়ায়নি। ফলে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও সাধারণ ভোক্তাদের সঙ্গে ন্যায্য বিচার করেনি।
সরকার আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দিলেও ১ নভেম্বর থেকে ভারত সরকার পেট্রোলে লিটার প্রতি ৫ রুপি ও ডিজেলে ১০ রুপি হারে উৎপাদন শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংগঠনটির আশা সরকার ভারতের দৃষ্টান্তটি বিবেচনায় নেবে।
বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হোসেন মো. মজুমদার জানান, ভাড়া সমন্বয় করতে সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
তিনি বলেন, ‘জ্বালানি তেলের দাম গতকাল হঠাৎ করে বাড়িয়েছে সরকার। এক দিন আগে বাড়িয়েছে ব্রিজ টোল। সেই ব্রিজ টোলটা ২৫৭ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছিল। তার এক দিন পর ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়িয়েছে। এখন আমাদের পরিবহন ভাড়া সমন্বয় ছাড়া কোনো গতি নেই।’