দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলের বিপরীতে ভারতের পেট্রাপোলে আটকে আছে পণ্যবোঝাই কয়েক হাজার ট্রাক। পেট্রাপোল বন্দরসংলগ্ন বনগাঁ কালিতলা পার্কিং ইয়ার্ডে পণ্যবোঝাই এসব ট্রাকের কোনো কোনোটির অপেক্ষার সময় মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। আর সেখানে পার্কিংয়ের নামে ট্রাকপ্রতি দিনে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে আমদানি পণ্য। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বাংলাদেশের আমদানিকারকরা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ও রাজস্ব আয়ে।
বেনাপোলের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বেনাপোল বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ পৌরসভার মেয়রের মালিকানাধীন কালিতলা পার্কিং ইয়ার্ড।
ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা ট্রাকগুলো পেট্রাপোল বন্দরের সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউজ করপোরেশনের টার্মিনালে না পাঠিয়ে ওই পার্কিং ইয়ার্ডে রেখে মাশুলের নামে যথেচ্ছ চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বেনাপোল বন্দর দিয়ে দুই দেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে এ ধরনের জটিলতা তৈরি করে ট্রাক থেকে প্রতিদিন আদায় করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এর পুরোটাই দিতে হচ্ছে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের।
চাঁদা আদায়ের জন্য সেখানে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এই চাঁদাবাজির কারণে আমদানি পণ্য বোঝাই একটি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করতে সময় লাগছে ৩০ থেকে ৩৫ দিন।
বেনাপোল বন্দর সূত্র জানায়, এই বন্দর দিয়ে প্রতিবছর ভারতের সঙ্গে অন্তত ৩০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। আর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় করে বেনাপোল কাস্টম হাউস।
পণ্যবাহী ট্রাক থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে আমদানিকারকরা বেনাপোল বন্দর ব্যবহার ছেড়ে অন্য বন্দরের দিকে ঝুঁকছেন।
সূত্র আরও জানায়, বেনাপোল বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ৪৫০ থেকে ৫০০ ট্রাক পণ্য আমদানি হতো ভারত থেকে। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৫০ থেকে ৩০০।
ভারত থেকে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো পেট্রাপোলে প্রবেশের আগে এক মাসেরও বেশি সময় আটকে রাখা হচ্ছে কালিতলা পার্কিংয়ে। প্রতিদিন ট্রাকপ্রতি ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে দুই হাজার টাকা।
এ ছাড়া জরুরি পণ্যের চালান আনার জন্য সিরিয়াল কিনতে সিন্ডিকেটকে দিতে হচ্ছে ট্রাকপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা। বনগাঁ ও পেট্রাপোল স্থলবন্দরে সিন্ডিকেটের এই দৌরাত্ম্য বাংলাদেশি আমদানিকারকদের জন্য নতুন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, নানামুখী চেষ্টা করেও এই সিন্ডিকেটের হাত থেকে তারা মুক্ত হতে পারছেন না। বাংলাদেশ ও ভারতীয় বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিবারই বলছে যে তারা বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছে।
তবে ওপারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিষয়টি রাজনৈতিক ইস্যু। রাজনৈতিকভাবে দেখা না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
আমদানিকারক আমিনুল হক আনু বলেন, বনগাঁ পৌরসভার সাবেক মেয়র শংকর আঢ্য ‘কালিতলা পার্কিং’ নামে একটি ব্যক্তিমালিকানাধীন পার্কিং ইয়ার্ড তৈরি করেন। সরকারি পার্কিং ইয়ার্ডের চেয়ে এটি আকারে বড়। তার লোকজন মোটামুটি জোর করেই আমদানি পণ্য বোঝাই ট্রাকগুলো সেখানে প্রবেশ করাতেন।
গত জুনে বর্তমান মেয়র গোপাল শেঠ দায়িত্ব নেয়ার পর আগের মেয়রের পথেই হাঁটছেন। প্রতিদিন ট্রাকপ্রতি পার্কিং খরচ নেয়া হচ্ছে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা। আর পার্কিংয়ের খরচটা ভারতের রপ্তানিকারকরা বাংলাদেশি আমদানিকারকদের কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছেন।
শুধু তাই নয়, ওখান থেকে প্রতিদিন কতটি ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করবে তা-ও নির্ধারণ করে দেয়া হচ্ছে। দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে আমদানি করা পণ্যও নষ্ট হচ্ছে।
ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স সাব-কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান বলেন, ‘বেনাপোল বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি করতে পেট্রাপোল বন্দরে একটি শক্তিশালী চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বনগাঁ পৌরসভার মেয়রের নেতৃত্বে তার লোকজন পণ্যবোঝাই প্রতিটি ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করছে।
‘পণ্যবোঝাই একটি ট্রাক ৩০ দিন ওপারে আটকে থাকলে আমদানিকারকের ৬০ হাজার রুপি পরিশোধ করতে হচ্ছে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনসহ দুই দেশের বিভিন্ন মহলে বারবার বিষয়টি জানানোর পরও সুরাহা হচ্ছে না।’
পেট্রাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, ‘বনগাঁ পৌরসভার তত্ত্বাবধানে সিরিয়ালের নামে এসব ট্রাক কালিতলা পার্কিংয়ে ঢোকানো হচ্ছে। এই চাঁদাবাজি বন্ধ হলে বাংলাদেশে দ্রুত পণ্য রপ্তানি করা সম্ভব হবে।’
বেনাপোল কাস্টম ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, ‘শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কাঁচামালের পাশাপাশি বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য আসে বেনাপোল বন্দর দিয়ে। আমদানিতে জটিলতার কারণে পচনশীল এসব পণ্য নষ্ট হচ্ছে। অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে। পণ্য আমদানিতে দীর্ঘসূত্রতায় অনেক আমদানিকারক অন্য বন্দরের দিকে ঝুঁকছেন।’
বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার আজিজুর রহমান বলেন, ‘পেট্রাপোল কালিতলা পার্কিং ইয়ার্ডে পণ্যবোঝাই প্রায় সাত হাজার ট্রাক আটকা পড়ে আছে বলে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি।
‘আমরা রাজস্ব আয় ও ট্রাকসংখ্যা বৃদ্ধি করতে ভারতীয় কাস্টমস ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করে যাচ্ছি। তবে সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না।’