গাইবান্ধায় যে অচেনা প্রাণীর হামলায় হতাহতসহ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, সেই প্রাণীর খোঁজে অভিযান চালিয়েছে রাজশাহী বন বিভাগ। চার ঘণ্টার টানা অভিযানে কোনো অচেনা প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে পাননি তারা।
বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের ধারণা, মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে গ্রামবাসীকে আতঙ্কিত করা হচ্ছে। তবে হতাহতে ঘটনা জলাতঙ্ক আক্রান্ত অন্য কোনো প্রাণীর মাধ্যমে ঘটেছে।
অভিযানের বিষয়টি মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে নিউজবাংলাকে নিশ্চিত করেন রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বন্যপ্রাণী পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবীর।
তিনি জানান, বিকাল ৪টা থেকে টানা রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত গাইবান্ধার পলাশবাড়ি উপজেলার কয়েকটি গ্রামের বিভিন্ন ঝোঁপ জঙ্গলে অভিযান চালানো হয়। এসব এলাকায় বন বিভাগ সঠিক তথ্য উদঘাটনের চেষ্টা করেছে।
অভিযানে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে প্রাণীটি শনাক্তের জন্য কাজ করেন তারা। অভিযান শেষে সেই আতঙ্কিত প্রাণীর কোনো অস্তিত্ব পাননি দলের সদস্যরা। তাদের ধারণা, এটা গুজব।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে অচেনা প্রাণীর আতঙ্কে পিটিয়ে মারা হয়েছে শিয়াল-মেছোবিড়াল। ছবি: নিউজবাংলা
অভিযান পরিচালনা করে রাজশাহী বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ। এতে বন্যপ্রাণী পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর কবীর নেতৃত্বে অংশ নেন বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ কর্মকর্তা রাহাত হোসেন, বন্যপ্রাণী গবেষক মো. রাশেদ, গাজী সাইফ ও জুয়েল রানাসহ সাত সদস্য।
পরিদর্শন দলের প্রধান জাহাঙ্গীর কবীর বলেন, ‘দিনে ও রাতে দুই টাইমে এটা নিয়ে আমরা পর্যবেক্ষণ করেছি। সঠিক তথ্যটি বের করার চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন ক্লু দিয়ে প্রাণীটি শনাক্তের চেষ্টা করছি।
‘এলাকায় শিয়ালের সংখ্যা, রাত্রীকালীন সেখানে অন্য প্রাণীর বিচরণ আছে কিনা, র্যাবিস আক্রান্ত কোনো কুকুর আছে কিনা, সেটার উপদ্রব কেমন; সেখানকার মানুষদের মানসিকতা কেমন, তারা যে আতঙ্কের কথা বলছেন, সে ক্ষেত্রে তাদের স্বস্তির বিষয়টিও ভাবতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা গ্রামবাসীকে যেসব প্রতিরোধ কৌশল ও পরামর্শ দিচ্ছি তারা তা অবলম্বন করেননি। পরামর্শকে গুরুত্ব দেননি। তারা অনেকটাই অসত্য তথ্যে বিশ্বাসী। এটাকে আমরা গুজব বলতে পারি।’
অচেনা প্রাণী নিয়ে মানুষের চিন্তাধারা, আতঙ্ক ও অন্য প্রাণী হত্যার বিষয়টি একটি ছোট্ট গল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেন জাহাঙ্গীর কবীর। তিনি বলেন, ‘চিল পাখি কান ছিঁড়ে নিয়ে গেছে। এটা শুনেই পাখি ধরতে গেলাম। এখানকার ঘটনাটিও কিছুটা এই গল্পের মতোই ঘটে চলেছে।’
তবে হতাহতের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে অবাধে বন্যপ্রাণী হত্যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যা এই এলাকাগুলোতে ঘটানো হচ্ছে। ডুমুরগাছায় মেছো বিড়াল হত্যা করে ঝুলিয়ে রাখছে। এটা কখনোই কাম্য নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘অভিযানের সময় সন্ধ্যার দিকে আমরা এক জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে আছি। এ সময় চিল্লাচিল্লি শুনে দৌড়ে সেখানে গেছি। তখন একজন বলেন, ‘সেই প্রাণীটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।’ এটা শুনে তাকে প্রশ্ন করলাম, ‘সেই প্রাণী আপনি কীভাবে বুঝলেন?’ তখন তিনি বলছেন, ‘এই তো আমাকে ধাওয়া করছিল। দৌড়ে পালাইছি। আমাকে মেরেই ফেলত।’
এরপর আশেপাশে খোঁজাসহ সেখানকার লোকদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, ‘লোকটি কিছু না দেখেই চিল্লাইছে। এই ধরনের মানসিক সমস্যার কারণে সেখানে আতঙ্ক বেড়েছে।’
এদিকে, অচেনা প্রাণীর আতঙ্কে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে শিয়াল। গত কয়েক দিনে গ্রামের লোকজন অন্তত ১০টি শিয়াল মেরেছে। শিয়াল মারতে গিয়ে রোববার দুপুরে একটি মেছোবিড়াল পিটিয়ে মেরেছে একদল যুবক। মৃতদেহ রশিতে বেঁধে গাছে ঝুলিয়ে উল্লাসও করেছে তারা।
গ্রামবাসি বলছে, অচেনা প্রাণীর হামলার আতঙ্কে ঘর থেকে বের হতে পারছে না অনেকে। এরই মধ্যে হামলায় একজন মারা গেছেন বলে তাদের দাবি। অন্তত ১০ জন জানিয়েছে, তারা ওই প্রাণীর হামলার শিকার হয়েছে। তবে প্রাণীটি কী তা কেউ নিশ্চিত নন।
তারা বলছে, প্রাণীটির গায়ের রং লাল, সাদা ও ধূসর। শরীরে এক ধরনের ডোরাকাটা দাগ আছে। সামনের দুই পা আকারে ছোট ও মুখমণ্ডল লম্বা। লেজ আকারে বড় ও মোটা।
পলাশবাড়ীর হরিনাথপুর, তালুকজামিরা, কিশামত কেঁওয়াবাড়ি ও কেঁওয়াবাড়ি গ্রামে গত দেড় মাসে নানা সময় ওই প্রাণীটিকে দেখা গেছে বলে দাবি গ্রামবাসীর।
আতঙ্কে এসব গ্রামের লোকজন অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকেই বের হচ্ছেন না। যারা বের হচ্ছেন, তারা সুরক্ষার জন্য সঙ্গে লাঠি রাখছেন।
পলাশবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুজ্জামান নয়ন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বন বিভাগের কর্মীরা বিষয়টি নিয়ে গুরুত্বসহ মাঠে কাজ করছেন। এ ছাড়া হতাহতের আর্থিক সহযোগিতার জন্য দপ্তরে আবেদন পাঠান হয়েছে।’