ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে গানের দল মেঘদলের বিরুদ্ধে মামলা করা আইনজীবী ইমরুল হাসান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হচ্ছেন।
মেঘদলের সাত সদস্যের বিরুদ্ধে ২৮ অক্টোবর ঢাকা মহানগর হাকিম মইনুল ইসলামের আদালতে মামলার আবেদন করেন ইমরুল হাসান। এরপর আদালত মামলাটি গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেয়। আর এই মামলা নিয়েই চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই দাবি করেছেন, মেঘদলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। তবে ঢাকা আইনজীবী সমিতির সদস্য ইমরুল হাসান মঙ্গলবার নিউজবাংলাকে জানান, ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৫ (ক) ধারায় তিনি মামলা করেছেন।
দণ্ডবিধির ২৯৫ (ক) ধারায় এ-সংক্রান্ত অপরাধ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কোনো শ্রেণিবিশেষের ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে আবমাননা করে উক্ত শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃত বিদ্বেষাত্মক কার্যসমূহ।’
এই অপরাধের শাস্তির মাত্রা সম্পর্কে এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি, বাংলাদেশের নাগরিকদের যেকোনো শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর অপমানিত করার অভিপ্রায়ে ইচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষাত্মকভাবে উচ্চারিত বা লিখিত শব্দাবলির সাহায্যে বা দৃশ্যমান কোনো বস্তুর সাহায্যে উক্ত শ্রেণির ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমানিত করে বা অবমাননা করার চেষ্টা করে, সে ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে- যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’
দুর্গাপূজার সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলার প্রতিবাদে গত ২২ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ‘সহিংসতার বিরুদ্ধে কনসার্ট’ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে আয়োজিত কনসার্টে বেশ কয়েকটি ব্যান্ড ও একক শিল্পীসহ মেঘদলও সংগীত পরিবেশনা করে। ওই আয়োজনে মেঘদলের পরিবেশিত ‘ওম’ গানে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে মামলা করেন আইনজীবী ইমরুল হাসান।
‘ওম’ গানটি ২০০৪ সালে মেঘদলের ‘দ্রোহের মন্ত্রে ভালোবাসা’ শিরোনামের অ্যালবামে প্রথম প্রকাশিত হয়।
মামলার অভিযোগে ইমরুল হাসান বলেছেন, ২৬ অক্টোবর তিনি বাসায় অবস্থানের সময় সকাল ৭টার দিকে ইউটিউবে ঢোকেন। বিভিন্ন ভিডিও দেখার সময় দেখতে পান মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একটি দোয়া বা ইসলামি প্রার্থনা নিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ বাদ্যবাজনা তথা আধুনিক মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে বিকৃত সুরে গান আকারে গাওয়া হচ্ছে।
অভিযোগে আরও বলা হয়, গানের অনুষ্ঠানটি টিএসসিতে ভাস্কর্যের সামনে করা এবং পেছনে সাইনবোর্ড আকারে লেখা ছিল ‘সহিংসতা’। পবিত্র কালিমার অংশও গানের তালে পাঠ করা হয়েছে। ফলে এ গান তার ধর্মানুভূতিতে আঘাত হেনেছে।
ধর্মানুভূতিতে আঘাতের মামলা করে ব্যাপক পরিচিতি
ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ইমরুল এবারই প্রথম মামলা করেননি। পালাগানে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগ এনে গত বছরের ৩১ জানুয়ারি তিনি বাউলশিল্পী রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন।
সেই মামলায় রিতা ও তার দুই সহশিল্পীর বিরুদ্ধে গত ২৫ অক্টোবর অভিযোগ গঠন করেছে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হবে আগামী বছরের ২৭ জানুয়ারি।
এ ছাড়া একটি টেলিভিশন টক শোতে ‘মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ করে বক্তব্য দেয়ার অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে গত বছরের ২৫ অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন ইমরুল।
এক বছরে একের পর এক এ ধরনের মামলা করে বিভিন্ন সময়ে আলোচনার কেন্দ্রে এসেছেন ইমরুল হাসান।
পুরান ঢাকার আদালতপাড়ার শনি দেবের মন্দির ও শাঁখারী বাজার সড়কসংলগ্ন বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভান্ডারের দ্বিতীয় তলায় নিজ চেম্বারে মঙ্গলবার দুপুরে নিউজবাংলার কিছু প্রশ্নের উত্তর দেন ইমরুল।
তিনি জানান, মামলা করতে প্রথমে কদমতলী থানায় গিয়েছিলেন। তবে থানা কর্তৃপক্ষ অভিযোগ গ্রহণ না করে তাকে আদালতে মামলা করার পরামর্শ দেয়।
নিজে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত নন বলে দাবি করেন ইমরুল।
তিনি বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোল্লাহাট উপজেলার চুনখোলায়। আমার পিতামহ (দাদা) আলতাফ হোসেন চৌধুরী। মরহুম আলতাফ হোসেন চৌধুরী এলাকার প্রভাবশালী ও সম্মানিত মানুষ ছিলেন।’
এই বক্তব্যের সূত্র ধরে ইমরুলের গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছে নিউজবাংলা। তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জানান, বাগেরহাটের মোল্লাহাট উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের যে গ্রামে ইমরুলের বাড়ি, তার নাম গারফা। চুনখোলা এর পাশের গ্রামের নাম।
উদয়পুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মিজানুর রহমান মোল্লা ছবি দেখে ইমরুলের পরিচয় নিশ্চিত করে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ইমরুলের দাদা অনেক সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন। তিনি গ্রামে সালিশ-বিচার করতেন। ইমরুলরা তিন ভাই চার বোন।’
ইমরুলের পরিবারের সবাই একসময়ে বিএনপি করত জানিয়ে মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ক্ষমতা বদলের পর তারা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছে।’
ইমরুলের চাচা আকতার হোসেন চৌধুরী নিউজবাংলাকে জানান, ভাইদের মধ্যে ইমরুল সবার বড়। তিনি অবশ্য দাবি করেন, তাদের পরিবার সব সময়েই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
ঢাকায় ইমরুল হাসান নিউজবাংলাকে জানান, তিনি ২০১৩ সালে ঢাকা আইনজীবী সমিতির (ঢাকা বার) সদস্য পদ লাভ করেন।
এর বাইরে মামলার বিষয়ে কোনো প্রশ্নের জবাব দেবেন না জানিয়ে তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি কোনো গণমাধ্যম বা টেলিভিশনের সঙ্গে কথা বলছি না। মামলাসংক্রান্ত বিষয়ে সবাই যা খুশি নিউজ করছে। অনেকেই আমার কাছে ফোন করেছে। আমি তাদের জানিয়ে দিয়েছি, মামলার বিষয়ে কোনো কথা আমি বলছি না।’
ইমরুলের মামলায় মেঘদলের ভোকাল শিবু কুমার শিল, মেজবা-উর রহমান সুমন, গিটারিস্ট-ভোকাল রাশিদ শরীফ শোয়েব, বেজ গিটারিস্ট এম জি কিবারিয়া, ড্রামস আমজাদ হোসেন, কিবোর্ড তানভির দাউদ রনি, বাঁশি সৌরভ সরকারকে আসামি করা হয়েছে।