খোলা বারান্দায় রোদের আনাগোনা। স্কুল খুলেছে সকালেই, কিন্তু শিক্ষক ছাড়া কারও পদচারণা নেই। শ্রেণিকক্ষগুলোর দরজায় ঝুলছে তালা। শিক্ষার্থীরা স্কুলে আসছে না প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে। হামলা-মামলার ভয়ে শিক্ষার্থীরা ভয়ে বাড়ি থেকেও পলাতক।
মাগুরা সদরের জগদল ইউনিয়নের ২১ নম্বর সৈয়দ রুপাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই অবস্থায় উদ্বিগ্ন শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্টরা।
কেন এই পরিস্থিতি? শিক্ষার্থীরা কেন স্কুলে আসছে না?
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মুহম্মদ জান্নাত হোসেন জানান, এই এলাকায় চার খুনের ঘটনায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। হামলা-মামলার ভয়ে অনেকেই পরিবারসমেত এলাকা ছেড়েছেন। তাদের সঙ্গে গেছেন সন্তানরাও। এ কারণে স্কুলে প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে শিক্ষার্থীরা অনুপস্থিত।
প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘গত ১৫ অক্টোবর এই এলাকায় যে চারজন খুন হলো তখন পূজার ছুটি চলছিল স্কুলে। ছুটি শেষ হয় ১৭ তারিখে। স্কুল খুলে আমরা শিক্ষকরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলাম। কারণ এই স্কুলটি হানাহানি করা দুপক্ষের মাঝের এলাকায় পড়েছে। এজন্য স্কুল খুলে খুব ভয়ে আছি।’
প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমিসহ মোট পাঁচজন এই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে আছি। জগদল ইউনিয়নের ৩ ও ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাচ্চারা এই স্কুলের শিক্ষার্থী। ঘটনার পর থেকে অনেকে বাড়ি ছেড়েছে। দুপক্ষের মামলা হবার পর অনেক শিক্ষার্থীর পরিবারের লোকজনের আসামি হিসাবে নাম রয়েছে শুনেছি।
‘তাই সেসব পরিবার এলাকা ছেড়ে দেয়ার পর আর বাড়ি ফিরে আসছে না। কয়েকজন অভিভাবক এলেও তারা শিশুদের অন্য এলাকায় রেখে এসেছেন।’
স্কুলের অন্য শিক্ষকরা জানান, ফোনে অনেক অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, বাচ্চার নিরাপত্তা দিতে পারলে তারা স্কুলে পাঠাবেন। অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকের মোবাইল নাম্বার বন্ধ পাওয়া গেছে।
সরেজমিন রোববার স্কুলে দেখা যায় মাত্র তিনজন শিক্ষার্থী উপস্থিত। শিশু শ্রেণির এই শিক্ষার্থীদের বাড়ি সংঘর্ষ হওয়া এলাকার বাইরে হওয়ায় তারা স্কুলে এসেছে।
স্কুলের এক শিক্ষার্থীর মা জানান, মেয়ের বাবা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আসামি। তিনি এখন পলাতক।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘গোষ্টিগত দলাদলিতে আমরা কখনই ছিলাম না। একই এলাকায় থাকায় ইচ্ছা না থাকলেও এসব সামাজিক দলাদলির ভেতরে আমরা নিরীহ মানুষ জড়িয়ে পড়ি। ওর বাবা দিনমজুর। এখন আমার ঘরে খাবার নাই। বাচ্চা স্কুলে যাবে, তার থেকে বড় চিন্তা কী খেয়ে বেঁচে থাকব?’
মাগুরা সদর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলাম মুঠোফোনে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই এলাকায় যে ঘটনা ঘটেছে সেখানে বড়রা নেই বলে আমি জেনেছি। বাড়ির বড়রা নেই মানে শিশুরাও তাদের সঙ্গে জায়গা বদল করেছে।
‘ওই স্কুলটি জগদলের খুব ভালো একটা স্কুল। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা শিক্ষকদের স্কুল খুলে থাকতে বলেছি। পরিবেশ অনুকূল হলে আশা করি শিক্ষার্থীরা আবার স্কুলে আসবে।’
সংঘর্ষের ঘটনার পর মাগুরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কামরুল হাসান জানান, ওই গ্রামে বিবদমান দুটি পক্ষ রয়েছে। একটি ৩ নম্বর ওয়ার্ড ইউপি মেম্বার নজরুল ইসলামের, অপরটি গ্রাম্য মাতবর সবুর মোল্লা ও তার দুই ভাইয়ের।
জগদল ইউনিয়ন পরিষদের আসন্ন নিবার্চনে ৩ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নজরুল প্রার্থী হয়েছেন। এই ওয়ার্ডে তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হয়েছেন সৈয়দ হাসান নামে একজন। নজরুলের বিরোধী পক্ষ হওয়ায় হাসানকে সমর্থন দেয় সবুর মোল্লা ও তার পক্ষ। এ নিয়ে নজরুল ও সবুর মোল্লার মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়।
সেই বিরোধের জের ধরেই নজরুল ও সবুরের সমর্থকদের মধ্যে গত ১৫ অক্টোবর বিকালে সংঘর্ষ হয় বলে পুলিশের ধারণা। এতে দুই ভাই সবুর মোল্লা ও কবির মোল্লা, তাদের চাচাতো ভাই রহমান মোল্লা এবং মো. ইমরান নামে একজন নিহত হন।
এ ঘটনায় পরে নিহত সবুর মোল্লার পরিবার থেকে ৬৮ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। এর প্রধান আসামি ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নজরুল ইসলাম। এরপর নজরুল গ্রুপের ইমরান হত্যার ঘটনায় ৫২ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়।
মামলায় এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে বলে জানান সদর পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মামুন হোসেন।