করোনা থেকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে ৭০ শতাংশ লোককে টিকার দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পরিকল্পনা সরকারের। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আরও ৫৩ শতাংশ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ দিতে হবে। তবে টিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করা ও প্রয়োগের পরিসর না বাড়লে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা দেখছে বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে ৮০ লাখ ৯৩ হাজার ২৩৬ জনকে প্রথম ডোজের টিকা দেয়া হয়। এই ৮০ লাখ লোককে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়া সম্পন্ন হলে প্রায় ৩ কোটি মানুষ পূর্ণ দুই ডোজ টিকার আওতায় আসবেন। এর মাধ্যমে দেশের ১৭ শতাংশ মানুষ পূর্ণ দুই ডোজ টিকা পাবেন। এই ১৭ শতাংশ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজের আওতায় আসতে ৯ মাস সময় লাগছে। অথচ পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫৩ শতাংশ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ টিকার আওতায় আনতে সরকার হাতে সময় পাচ্ছে ছয় মাস। টিকা দানের পরিসর না বাড়লে এটি বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে করোনার টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। করোনা থেকে দেশের মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মাসে ২৫ লাখ লোককে টিকা দেওয়া রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়। তবে টিকা সংকটের কারণে এর বাস্তবায়ন তেমন সম্ভব হয়নি কয়েক মাসে। এখন প্রতি মাসে সাড়ে ৩ লাখ করে টিকা দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।
আগামী মার্চের মধ্যে ১২ কোটি মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার চিন্তা সরকারের। কিন্তু টিকার বর্তমান গতি ও সরবরাহের কারণে আগামী মার্চ-এপ্রিলের মধ্যে এতো লোককে টিকা দেয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এমনকি বর্তমানে সরকার যে হারে টিকা দেয়া হচ্ছে, সে অনুযায়ী ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিতে সরকারের সময় লাগবে আড়াই বছর।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিক ২০২০’ তথ্য অনুযায়ী দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯১ লাখ ১০ হাজার। সে হিসেবে ১৩ কোটি ৫২ লাখ ৮৮ হাজার মানুষের টিকা পাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু গত বুধবার পর্যন্ত ৭ মাসে পূর্ণ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন মাত্র ২ কোটি ১৩ লাখ ৩২ হাজার ২৮৯ জন অর্থাৎ জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ।
এখন টিকা দিতে হবে বাকি ৫৩ শতাংশ মানুষকে। বুধবার পর্যন্ত মোট ৬ কোটি ২৬ লাখ ১ হাজার ১৫৩ ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজ দেয়া হয়েছে ৪ কোটি ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৮১০ জনকে। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত করোনার টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন ৫ কোটি ৭৩ লাখ ৮ হাজার ৯৫৮ জন।
নভেম্বরে গতি পাবে টিকাদান
দ্রুত সময়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের টিকার আওতায় আনতে টিকাদানের পরিসর বাড়ানোর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। বর্তমানে দৈনিক ৫ থেকে ৬ লাখ মানুষকে টিকা দেওয়া হলেও আগামীতে দৈনিক ১০ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয় হবে। এছাড়া ১ নভেম্বর থেকে স্কুল শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া শুরু হচ্ছে। প্রতিদিন ৪০ হাজার শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য শামসুল হক বলেন, ‘দ্রুত সময়ের মধ্যে অধিক মানুষকে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনতে চায় সরকার। আমরা দিনে ৪ থেকে ৫ লাখ ডোজ টিকা দিচ্ছি এবং প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫ লাখ ডোজ দেওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।’
দেশে করোনা প্রতিরোধে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু হওয়ার পর ভ্যাকসিনের স্বল্পতার কারণে বার বার ব্যাহত হয় গণটিকাদান কর্মসূচি। একই সঙ্গে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট হঠাৎ করে টিকা সরবরাহ বন্ধ রাখায় নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি প্রায় এক মাসের জন্য স্থগিত হয়ে পড়ে। তবে জুনে চীন থেকে দেড় কোটি ডোজ সিনোফার্ম টিকা কেনার পর টিকাদান কর্মসূচি আবারও কিছুটা গতি পায়। এরপর ধারাবাহিকভাবে টিকাদান কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
সরকার এখন যে হারে টিকা দিচ্ছে, তাতে ৮০ শতাংশ মানুষের টিকা দিতে চার বছর আট মাস সময় লেগে যাওয়ার কথা। তবে গণটিকাদান কর্মসূচির আদলে যদি টিকা দেওয়া হয়, তাহলে এই সময়সীমা কমে আসবে ২ বছর ৪ মাসে।
এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এটা পরিষ্কার, টিকার প্রাপ্যতার ওপর টিকাদানের গতি নির্ভর করে। বাংলাদেশ গণটিকার আদলে যে পরিমাণ টিকা দিয়েছে, তার তিনগুণ টিকা দেওয়ার সক্ষমতা স্বাস্থ্য বিভাগের রয়েছে। আমরা যথেষ্ট পরিমাণ টিকা পাচ্ছি না। তাই দিতে পারছি না। যে কারণে শঙ্কা থেকেই যায়। উন্নত দেশগুলো যে পরিমাণ টিকা পাচ্ছে, আমরা পেলে আমাদের লক্ষ্য মাত্রা পূরণ করতে পারব।’
এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ভাবছে, আমাদের কাছে টিকা এলে আমরা টিকার যথেষ্ট ব্যবহার করতে পারব না। তাই তারা দিচ্ছে না। আমরা টিকা বৈষম্যের মধ্যে পড়ে গেছি। এই বৈষম্য দূর করতে হলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হাতকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।’
টিকার অভাব হবে না জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেহেতু আমরা ধারাবাহিকভাবে টিকা পাচ্ছি, আগামীতে টিকার পরিসর বাড়বে। দৈনিক টিকা দেয়ার হার আমরা বৃদ্ধি করব। আগামী মাস থেকে দৈনিক ১০ থেকে ১৫ লাখ টিকা দেওয়া হবে। এর পাশাপাশি মাসে বড় একটি ক্যাম্পেইন করা হবে। এ ছাড়া নভেম্বর শুরু হচ্ছে স্কুল শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া। রাজধানীর ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দিনে ৪০ হাজার ডোজ টিকা দেয়া হবে।’
জাহিদ মালেক বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি দেশের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ টিকা দিয়ে থাকে, তবে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছে, জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হবে। এমনকি তারা টিকা উৎপাদনের জন্য কাঁচামাল দেয়ার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের যে টিকা পাওয়ার তালিকা দিয়েছে, সেই তালিকা দেওয়া হয়েছে। সিডিউল অনুযায়ী আমরা যদি টিকা পাই, তাহলে ডিসেম্বর মধ্যে ৮ কোটি ও মার্চের মধ্যে ১২ কোটি মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া হবে। ১২ কোটি মানুষকে মার্চের মধ্যে যদি আমার টিকা দিতে পারি, তাহলে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষকে আমাদের টিকা দেওয়া হয়ে যাবে।’