৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত মা ইলিশ রক্ষায় ইলিশ শিকার বন্ধ ছিল নদ-নদীতে। নিষেধাজ্ঞা শেষে ২৬ অক্টোবর মঙ্গলবার বরিশালের পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে বিপুল পরিমাণে ইলিশ আমদানি হলেও এক দিনের ব্যবধানে সেই ইলিশের সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে।
মঙ্গলবার ৪ হাজার মণ ইলিশ এসেছিল মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে। অথচ বুধবার ইলিশের দেখাই মিলছে না। আড়তদাররা মঙ্গলবার জানিয়েছিলেন, পর্যাপ্ত ইলিশ রয়েছে নদীতে। বুধবার বলছেন, নদীতে ইলিশ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিষেধাজ্ঞার সময় গোপনে অবৈধভাবে শিকার করা ইলিশ নিষেধাজ্ঞা শেষে তোলা হয় বাজারে। যে কারণে নিষেধাজ্ঞা শেষের পরের দিন প্রচুর ইলিশ ছিল এই বাজারে।
বুধবার সকালে গিয়ে প্রায় ইলিশশূন্য দেখা গেছে পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র। ঘাটে যে নৌকাগুলো ছিল, তাতেও ইলিশের পরিমাণ খুবই কম। মঙ্গলবারে আসা ইলিশের তুলনায় এটি অস্বাভাবিক।
সিরাজুল ইসলাম নামের এক জেলে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সবাই মনে করছে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় ইলিশ ধরা বন্ধ ছিল। ডাহা মিথ্যা কথা। যারা জেনুইন জেলে, হেরা বাদে নদীর পাড়ের দোহানদাররাও ইলিশ ধরছে। দিনে দোহানদারি করত, নাইলে অন্য কাম করত, আর রাইতে নামত জাল লইয়া। এরা কোনো জেলে না, এরা হইছে সুযোগ ব্যবহার করছে। এই সব লোকজন যে ইলিশগুলা ধরছে, হেয়া তো আর সব বেঁচতে পারে নাই। ওই মাছগুলা বরফ দিয়া রাখছিল এতদিন, নিষেধাজ্ঞা শেষ হইছে আর মাছগুলা পোর্ট রোডে লইয়া আইছে। এইর জন্য আপনেরা কাইলগো এত ইলিশ দেখছেন। মেইন কথা হইছে এহন ইলিশ তেমন নাই নদীতে, যাও ধরা পরে হেয়ার পেটে ডিম পাওয়া যায়।’
পোর্ট রোডের পাইকারি এক ইলিশের আড়তদার নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, ‘বরিশাল বেল্টের শায়েস্তাবাদ, লামছড়ি, চন্দ্রমোহন, বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠি, মেহেন্দীগঞ্জ, হিজলার মেঘনা নদীর বিভিন্ন শাখা নদীতে টানা ইলিশ শিকার চলছে।
‘যারা ইলিশ ধরত, তারা বিভিন্ন স্পটে লোক দাঁড় করাইয়া রাখত। পুলিশ বা কোস্ট গার্ড গেলেই যেন খবর দেয়। আর সেই মোতাবেক কাম চালাইছে।
‘নিষেধাজ্ঞার মধ্যে নিজেগো ধারে ইলিশ মজুত কইরা রাখছিল, নিষেধাজ্ঞা শেষ এহন বাজারে আনছে। তয় এসব লোকজন ধরা খাইছে মোগো মতো আড়তদারগো লগে। কেননা রাত ১২টায় নিষেধাজ্ঞা শেষ হইছে, ৬ ঘণ্টার মধ্যে মাছ ধইরা আনছে, তাও আবার পাইছি পচা। ৬ ঘণ্টার মধ্যে মাছ ধরলে সেগুলা তো পচার কথা না। তার মানে ইলিশগুলা আগেই ধরা ছিল।
বরিশালের পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র
‘আর বড় বিষয় হইছে, ছয় ঘণ্টায় হাজার হাজার মণ ইলিশ আইছে পোর্ট রোডে, আর সারা দিন ইলিশ ধরার পরও বাজারে খালি দেশি মাছ কেন? ফাও কথা কইয়া তো লাভ নাই, ইলিশের নিষেধাজ্ঞার সময় বাস্তবায়ন হইত, যদি আমাগো মতো আড়তদাররা ভালো হইত। আমরাই তো পাইলা-পুইষা রাখি অবৈধ ইলিশ শিকার যারা করে তাদের।’
শায়েস্তাবাদের আড়িয়াল খাঁ নদের জেলে মোহাম্মদ কাওছার বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞার সময় মূল চান্সটা লয় স্থানীয় লোকজন। হেরা পোলাপান ফিট কইরা নদীতে নামাইয়া দেয় রাইতের বেলা। হারা রাইত মাছ ধরা শেষে যদি কিছু বেচতে পারে তয় তো ভালো, নাইলে নদীর পাড়েই মাটি গর্ত কইরা হোগলা বিছাইয়া হেইয়ার উপর বরফ দিয়া মাছ রাইখা দেয়। ওরহম মাছ রাখলে কিছু হয় না। নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর মাছগুলা বেইচ্চা হালাইছে কাইলগো। নিষেধাজ্ঞার সময় ইলিশ ধরার পিছনে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হইতে শুরু কইরা কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যও জড়িত আছে।’
পোর্ট রোডের ইলিশ আড়তদার সায়েম হোসেন বলেন, ‘মঙ্গলবার ৩ থেকে ৪ হাজার মণ ইলিশ এসেছে এই পাইকারি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে। কিন্তু আজকে ৪০০ মণ হয় কি না সন্দেহ। জেলেদের সাথে কথা বলছি, তারা বলছে, নদীতে মাছ নেই। যা ইলিশ পাচ্ছে তার মধ্যে ডিম পাওয়া যাচ্ছে। সরকারের ইলিশ নিয়ে গবেষণা বাড়ানো দরকার। নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা পরিবর্তন দরকার।’
বরিশালের পোর্ট রোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র
তিনি বলেন, ‘মঙ্গলবার যে দামে ইলিশ বিক্রি হয়েছে, আজ সেই দাম প্রায় দ্বিগুণ। ইলিশই তো নেই বলা যায় আজ। মঙ্গলবারে এই বাজারে ১২০০ থেকে ১৪০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ কেজি প্রতি ১ হাজার টাকা, ১৪০০ থেকে ১৮০০ গ্রাম প্রতি কেজি ১১০০ টাকা, এক কেজির বেশি ওজনের মাছে ৯০০ টাকা, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রাম ওজনের মাছে ৭০০ টাকা কেজি, দুটিতে এক কেজি ওজনের মাছ কেজি প্রতি ৬০০ টাকা, তিনটিতে এক কেজি ওজনের মাছ ৫০০ টাকা এবং আট থেকে নয়টিতে কেজি মাছের দাম ২৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে আজ এই বাজারে এই ইলিশের দাম কেজি প্রতি ২০০ থেকে ৪০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। যাতে অনেক ক্রেতাই সকালবেলা এসে ফিরে গেছে দাম না মিলাতে না পেরে। পোর্ট রোডে যে ইলিশ আজকে উঠেছে, তার থেকে কয়েক গুণ বেশি ইলিশ নগরীর খুচরা বাজারগুলোতে প্রতিদিন থাকে।’
বরিশালের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা শেষে সব জেলে একসঙ্গে নেমেছে ইলিশ শিকারে। নদীতে প্রচুর ইলিশ রয়েছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে অভিযান পরিচালনা করেছি। নৌপুলিশ, কোস্ট গার্ড থেকে শুরু করে মৎস্য অধিদপ্তর কাউকে ছাড় দেয়নি।’