কিশোরগঞ্জে পাঁচ বছর ধরে স্কুলে না পড়িয়েও বেতনভাতা তোলা সেই শিক্ষিক মেহবুবা রায়নার অব্যাহতিপত্র গ্রহণ করেছে উপজেলা শিক্ষা কার্যালয়।
কিশোরগঞ্জ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত কুমার বণিক সোমবার বিকেলে নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
চাকরি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মেহবুবা রায়না করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
সুব্রত কুমার বণিক নিউজবাংলাকে জানান, স্কুলে না গিয়ে মেডিক্যাল ছুটি নিয়ে বছরের পর বছর স্কুলে অনুপস্থিত থাকার কারণে গত ১৭ অক্টোবর রায়নার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়।
তিনি আরও জানান, ১৮ অক্টোবর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে তিনি চিঠি দেন। তবে তার আবেদনপত্রে নানা ভুলত্রুটি ছিল বলে পুনরায় তাকে আবেদন করতে বলা হয়। পরদিন উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে পুনরায় আবেদন করেন রায়না।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সুব্রত কুমার জানান, পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে চাকরি করা সম্ভব হচ্ছে না বলে আবেদনে উল্লেখ করেছেন রায়না। সরকারি বিধি অনুযায়ী ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে গত সেপ্টেম্বর মাসের মূল বেতনের অর্ধেক টাকা জমা দিয়েছেন তিনি।
আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২১ অক্টোবর করিমগঞ্জ উপজেলার সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম তালুকদার বিষয়টি আমলে নেন।
রফিকুল ইসলাম তালুকদার জানান, ডাকযোগে মেহবুবা রায়নার চাকরি থেকে অব্যাহতির আবেদনপত্র হাতে পান তিনি। আবেদনপত্রে তার চাকরিতে যোগদানসহ কোনো তারিখের উল্লেখ ছিল না। চাকরি থেকে কবে তিনি অব্যাহতি নিতে চান সে বিষয়টিও উল্লেখ করেননি তিনি।
এ কর্মকর্তা আরও জানান, অব্যাহতির আবেদনের ক্ষেত্রে হাজির হয়ে সই করে আবেদন জমা দেয়ার নিয়ম থাকলেও ওই শিক্ষক ডাকযোগে আবেদন করেছেন।
তা ছাড়া অব্যাহতির বিষয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা সহকারী কর্মকর্তাকেও অবগত করেননি তিনি। পরে নিজে উপস্থিত হয়ে আবেদনপত্র জমা দেয়ার বিষয়টি আমলে নিয়ে সোমবার রায়নার অব্যাহতিপত্রে সই করেন রফিকুল ইসলাম তালুকদার।
অব্যাহতি দেয়ার তারিখ ১৮ অক্টোবর ধরে ওই দিন থেকেই পদটি শূন্য ধরা হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।
গত ১৫ অক্টোবর ‘তিনি ক্লাস না করিয়ে বেতন তুলছেন পাঁচ বছর ধরে’ শিরোনামে চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মেহবুবা রায়নাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে নিউজবাংলা।
এরপরপই ফেসবুকে কিশোরগঞ্জ জেলাভিত্তিক বিভিন্ন গ্রুপে শুরু হয় সমালোচনা। এই অনিয়মের জন্য জেলা এবং উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তাদের দায়ী করে মন্তব্য করেন অনেকে।
রায়না ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যে স্নাতক শেষ করে এখন স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে পড়ছেন। তিনি ২০১৬ সালে চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ২০১৪-২০১৫ সেশনে।
চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, ২০১৬ সালে রায়না স্কুলে যোগ দিয়ে তিন মাস নিয়মিত ক্লাস নিয়েছেন। এরপর স্কুলে যাননি টানা তিন বছর। ২০২০ সালের মার্চে করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগে ছয় মাস মাঝেমধ্যে আসতেন। করোনা শুরু হলে অন্য শিক্ষকরা স্কুলে এলেও তিনি আসেননি এক দিনের জন্যও।
স্কুলটির একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, ‘আমরা সারা বছর পরিশ্রম করে যে বেতন পাই, রায়না তার কিছুই না করেও একই বেতন পাচ্ছেন।
‘রায়না সরকারি চাকরি করে কর্মস্থলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার বিষয়টি গোপন করেছেন, আবার অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়েও চাকরির ব্যাপারটা গোপন করেছেন। তিনি একসঙ্গে দুটি অপরাধ করেছেন।’
রায়নার ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার তথ্য সেখানে উল্লেখ করেছেন। তিনি ময়মনসিংহে বসবাস করছেন এবং সেখানে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর ছবি নিয়মিত আপডেটও করেন।
চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী রায়নার নামও বলতে পারেনি। কারণ জানতে চাইলে সে বলে, ‘হেই ম্যাডাম পহেলা কয়েক দিন ইস্কুলে আইছে, পরে আর আইছে না। হের লাইগ্যে হেই ম্যাডামের নামটা মনে নাই।’
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘মেহবুবা রায়না বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকার কারণে ২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তার ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করা হয়। পরে তাকে বিদ্যালয়ে যোগদানের অনুমতি দেয়া হয়।’
তিনি জানান, রায়না চাকরিতে যোগ দেয়ার পর তিনি বিভিন্ন মেয়াদে শুধু মেডিক্যাল ছুটি কাটিয়েছেন ২১৩ দিন। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর স্কুল খোলার পর ১২ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিনা অনুমতিতে অনুপস্থিত থাকার কারণে ২৩ সেপ্টেম্বর তার কৈফিয়ত তলব করা হয়। দায়িত্বে অবহেলার কারণে কেন তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তিন কার্যদিবসের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব চাওয়া হয়।
এরপর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম তালুকদার বিষয়টি তদন্ত করেন৷ তদন্ত প্রতিবেদনে তিনি জানান, রায়না ওয়ার্কশিট বিতরণ ও মূল্যায়ন এবং অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগসংক্রান্ত কোনো কাজেও অংশগ্রহণ করেননি৷ তাকে প্রধান শিক্ষক ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা জানালেও তিনি গুরুত্ব দেননি।
পরে রায়নার বেতন বন্ধ করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করেন মফিজুল ইসলাম। আর গত ২৩ সেপ্টেম্বর মেহবুবা রায়নাকে শোকজ করা হয়। ২৭ সেপ্টেম্বর ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে এর জবাব দেন রায়না। কিন্তু জবাব সন্তোষজনক মনে না হওয়ায় রায়নার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে ফাইলটি জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়।
এ বিষয়ে কথা বলতে রায়নার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ধরেননি। পরে মেসেজ দিয়েও তার সাড়া পাওয়া যায়নি।
তার হোয়াটস অ্যাপ এবং ফেসবুক মেসেঞ্জারে একাধিকবার বার্তা পাঠানোর পর তিনি নিউজবাংলার প্রতিবেদককে ব্লক করে দেন।