ধানসহ অন্য ফসলে কৃষকরা অনেকটাই অনিশ্চয়তা কাটাচ্ছিলেন। অনেক সময় চাষের খরচ উঠাতে পারছিলেন না। অন্য দিকে সবজি চাষে ফলন ভালো ও প্রত্যাশিত দাম পাওয়ায় রাজশাহী অঞ্চলের চাষিরা বাড়াচ্ছেন চাষাবাদ।
কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, গত দশ বছরে রাজশাহীতে সবজি চাষের জমি বেড়েছে প্রায় দেড় গুণ। এই সময়ে সবজির উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ১৬ গুণ।
কৃষি বিভাগ ও গবেষকরা বলছেন, আগে যেসব জমিতে শুধু শীতের সময় সবজির আবাদ হতো, এখন এমন অনেক জমিতেই বছরজুড়ে সবজি চাষ হচ্ছে।
রাজশাহীর দুর্গাপুর এলাকার কৃষক ফারুক হোসেন। আগে তার জমিতে করতেন ধান চাষ। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ধান পেলেও সে অনুযায়ী দাম পেতেন না। কোনো কোনো বছর খরচের টাকা উঠত না ধান চাষে। সিদ্ধান্ত নেন জমি ইজারা দেবেন। আর কোনো চাষাবাদই করবেন না।
পরে এক শুভাকাঙ্ক্ষীর পরামর্শে জমি কিছুটা উঁচু করে শুরু করেন মৌসুমি সবজির চাষ। অল্প সময়ে লাভের মুখ দেখেন। তিন বছর ধরে সবজিতে তিনি লাভ করে আসছেন। এখন আর্থিক অসচ্ছলতা দূর হয়ে বাড়িয়েছেন চাষের জমিও।
ফারুক বলেন, ‘এবার দুই বিঘা জমিতে পুঁইশাক আর তার মধ্যেই বেগুনগাছ লাগিয়েছেন। এখানে হালকা কীটনাশক ও পরিচর্যা করলেই হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সাপ্তাহিক হাটবারে আমরা ফসল উঠাই। বাজারে বেশ চাহিদা থাকায় দামও পাচ্ছি ভালো। প্রতি আঁটি পুঁইশাক বিক্রি করি ছয় থেকে আট টাকায়। আর বেগুনের বাজার ওঠানামা করে। তবে কখনোই লোকসান হয়নি।’
একই উপজেলার কৃষক জব্বার আলী। তিনি আগে ধান, গম, পাট চাষ করতেন। পরিশ্রম করা ফসল নিয়ে বাজারের দামের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো। কবে ভালো দাম উঠবে। অনেক সময় পরিশ্রমের তুলনায় কাঙ্ক্ষিত দাম না মেলায় লোকসান গুনতে হয়। হতাশ হয়ে তিনিও এখন সবজি চাষ করছেন। ফিরেছে সচ্ছলতা।
জব্বার আলী বলেন, ‘অন্য ফসলের তুলনায় সবজিতে ফলন পাওয়া যায়। এক সঙ্গে অনেক সবজি চাষ করা যায়। আর বাজারে চাহিদা ভালো থাকায় দামও বেশি পাওয়া যায়।
‘সবজির পরিচর্যা করতে হয় বেশি, তাই পরিশ্রমও বেশি। সবজির ক্ষেত্রে লোকসান ঘটে না। বাজারে নিয়ে গিয়ে ভালো দামে স্বল্প সময়ে বিক্রি করা যায়। সে জন্যই আমি ধানের পরিবর্তে বিভিন্ন সবজি চাষ করি।’
জব্বার আলী বলেন, এখন ১০ শতক জমিতে করলা ক্ষেত রয়েছে। ফলন এখনও দিচ্ছে। এরই মধ্যে ৫০ হাজার টাকার বিক্রিও করেছেন। আরও ৫০ হাজার টাকার বিক্রির আশা রয়েছে তার। সব মিলে সেখানে ৩০ হাজার টাকার মতো তার খরচ হয়েছে বলেও জানান।
ফারুক আর জব্বারের মতো রাজশাহীর অনেক চাষিই দিন দিন ঝুঁকছেন সবজি চাষে। প্রতিটি উপজেলাতেই বাড়ছে সবজি চাষের আগ্রহ।
গত দশ বছরে রাজশাহী জেলায় ৭ হাজার ৯৩১ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ বেড়েছে। এ সময়ে ফলন বেড়েছে কয়েক গুণ বেশি।
কৃষি বিভাগের তথ্যে দেখা যায়, ১০ বছরে ফলন বেড়েছে ৫৩ হাজার ৯০ হাজার ৭৩৪ মেট্রিক টন।
২০১৯ সালে সবজিতে দেশসেরা হওয়ার খেতাবও মিলেছে রাজশাহীর।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে রাজশাহীতে বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ হয় ১৯ হাজার ৪০৮ হেক্টর জমিতে। সে বছর উৎপাদন ছিল ৩ লাখ ৩৮ হাজার ৮৭ মেট্রিক টন। আর ২০২০ সালে সবজি চাষ হয় ২৭ হাজার ৩৩৯ হেক্টর জমিতে। সেই তুলনায় উৎপাদন বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এ বছর সবজি উৎপাদন হয় ৫৪ লাখ ২৪ হাজার ৬০ মেট্রিক টন। অর্থাৎ এই দশ বছরে জমি বেড়ে হয়েছে প্রায় দেড় গুণ। আর সবজির উৎপাদন বেড়েছে ১৬ গুণ।
চলতি বছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে রবি মৌসুমের সবজি আবাদ শুরু হয়। প্রতিদিনই বাড়ছে সবজির জমির পরিমাণ।
গত ২-৩ বছর ধরে রাজশাহীতে প্রায় ১৩০ হেক্টর জমিতে বেগুন, ২৫ হেক্টরে ফুলকপি, ১৩ হেক্টরে বাঁধাকপি, ৮০ হেক্টরে মুলা, ৩৫ হেক্টরে লাউ, ৭৫ হেক্টরে শিম, ১০ হেক্টরে বরবটি, ১ হেক্টরে শসা, ৫ হেক্টরে করলা, ১০ হেক্টরে ঢ্যাঁড়শ, ২০ হেক্টরে মিষ্টিকুমড়া, ১ হেক্টরে ডাটাশাক, ৮০ হেক্টরে লালশাক, ১৫ হেক্টরে পালংশাক, ২ হেক্টরে পুঁইশাক, ৩ হেক্টরে কলমিশাক এবং প্রায় আড়াই শ হেক্টরে জমিতে টম্যাটোর আবাদ হয়।
সরেজমিনে রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাজশাহী জেলার পবা, দুর্গাপুর, বাগমারা, চারঘাট, তানোর গোদাগাড়ীর মাঠজুড়ে চাষ করা হয়েছে বাঁধাকপি, ফুলকপি, টম্যাটো, শিম, মুলা, লালশাক-পালংশাক, সবুজ শাকসহ নানা ধরনের সবজি।
পবা উপজেলার কৃষক জয়নাল হোসেন বলেন, ‘শীত মৌসুম শুরুর আগেই শীতকালীন সবজি চাষ করেছেন। ফুলকপি ও মুলার চাষ করেছেন তিনি। শুরুতে দাম ভালো পাওয়ার আশা করছেন।
এরই মধ্যে ফুলকপি বাজারে পাঠাতে শুরু করেছেন। প্রথমে প্রতি কেজি ফুলকপির দাম পেয়েছেন ১০০ টাকা। এখন ৪৫ থেকে ৫০ টাকা করে পাচ্ছেন। জয়নাল তার প্রত্যাশিত দাম পেয়ে খুশি।
তিনি বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে যে খরচ হয়েছিল, এরই মধ্যে তা উঠে গেছে। জমিতে এখনও যে কপি আছে সেগুলো বিক্রি করলে সবটাই লাভ হবে।’
গোদাগাড়ীর কৃষক শফিকুল ইসলাম জানা, এখন টম্যাটোর সময়। ছয় বছর ধরে তিনি টম্যাটো চাষ করছেন। এবার তিন বিঘা জমিতে টম্যাটো লাগিয়েছেন।
শফিকুল বলেন, ‘শুরুতে টম্যাটোর দাম ভালো থাকে। কিন্তু শেষের দিকে একেবারে দাম পড়ে যায়। অনেক সময় শ্রমিকের দামই ওঠে না। তার পরও প্রথম দিকে যে টাকাটা আসে সেটাতেই লাভ হয়।’
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কে জে এম আব্দুল আওয়াল বলেন, ‘দিন দিন কৃষকের সবজি চাষে আগ্রহ বাড়ছে। সে সঙ্গে মানুষেরও সবজির প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। আগাম জাতের সবজি চাষ বেশি হচ্ছে। এতে লাভবানও হচ্ছেন।’
তিনি বলেন, সারা দেশে ১০ বছরে আগের তুলনায় উৎপাদন বেড়েছে। রাজশাহীর পবার বেশ কিছু এলাকা সবজির জন্য বিখ্যাত। এবারও বেশি চাষ হয়েছে। অনেকেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে চাষ করছেন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অফ বায়োলজিক্যাল সায়েন্স- আইবিএসের পরিচালক ড. এম মনজুর হোসেন বলেন, ‘সবজির আবাদ অনুপাতে উৎপাদন এখন অনেক গুণ বেড়েছে। এটির বেশ কয়েকটি কারণ আছে। যার একটি একই জমিতে এখন সারা বছরে ৩-৪ বার সবজির চাষ হচ্ছে।
‘আগে হয়তো একবার বা বড়জোর দুইবার হতো। আমরা যেগুলোকে শীতকালীন সবজি বলি, তার অনেকগুলোই এখন সারা বছরই পাওয়া যায়। কৃষকরা এখন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শিখেছেন। উন্নত চাষাবাদ পদ্ধতির ব্যবহার হচ্ছে।’
তিনি বলেন, যেসব জাতের ফলন বেশি, সেগুলোর চাষেও আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা। এসব কারণে উৎপাদন বৃদ্ধির হার অনেক বেশি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, চাষিরা ভালো দাম পাচ্ছেন, এ কারণে চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।