বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দেড় শ বছরের সম্প্রীতিতে আঁচড়

  •    
  • ২৪ অক্টোবর, ২০২১ ০৯:৩৭

ফেনীতে মসজিদ-মন্দির পাশাপাশি। দেড় শ বছর ধরে সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে উপাসনা করছিলেন দুই সম্প্রদায়ের লোক। ১৬ অক্টোবর সংঘাতে সেই সম্প্রীতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, কিছু বহিরাগত যুবক ও কিশোর হামলায় অংশ নেয়।   

ফেনী শহরের প্রাণকেন্দ্রে কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদ ও কেন্দ্রীয় কালীমন্দির পাশাপাশি। একই ব্যক্তি এ দুটি ধর্মীয় উপাসনালয় নির্মাণ করেছেন। উদ্যোক্তা ত্রিপুরার মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর।

হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির জন্য তাদের উপাসনার এ জায়গা তৈরি করে দিয়েছেন মহারাজা। দেড় শ বছর ধরে সে সম্প্রীতি বজায় রেখে দুই ধর্মের লোকেরা যার যার ধর্মীয় উপাসনা পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

গত ১৬ অক্টোবর সে সম্প্রীতি ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। দফায় দফায় হিন্দু-মুসলিম ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়েছে। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অগণিত। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মসজিদ-মন্দির। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কয়েক শ ফাঁকা গুলি ছোড়েন।

কীভাবে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত, তার সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য মতে, ওই দিন (১৬ অক্টোবর) আসরের নামাজ শেষে ফেনী বড় জামে মসজিদের সামনে অবস্থান করছিলেন মুসল্লিরা। একই সময়ে কালীবাড়ি মন্দিরের সামনে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির আলোকে প্রতিবাদ সভা ও শহীদ মিনারে মানববন্ধনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ফেনী জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ নেতারা। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।

মুসল্লিদের দাবি, আসরের নামাজের সময় মসজিদের সামনে হিন্দুরা উলুধ্বনি দেয়ার পর মুসল্লিরা ক্ষেপে যান। তারা প্রতিবাদ করলে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। মাগরিবের নামাজের পর ছাত্রলীগ-যুবলীগ মুসল্লিদের বিক্ষোভে অতর্কিতে হামলা করলে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে যায়।

হিন্দু সম্প্রদায়ের দাবি, প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে বের হতে চাইলে কিছু দুর্বৃত্ত পরিস্থিতি সংঘাতের দিকে টেনে নেয়ার চেষ্টা করে। পরে পুলিশের অনুরোধে তারা কালীবাড়ি মন্দিরের ভেতরে চলে আসেন।

পুলিশ সেখানে উপস্থিত মুসলমানদের সরাতে চাইলেও তারা জায়গা ছাড়তে রাজি হননি। মুসল্লিদের মধ্যে দুর্বৃত্তরা অবস্থান নিয়ে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে। এরপর মসজিদের সামনে অবস্থানরত দুর্বৃত্তরা উসকানিমূলক স্লোগান দিয়ে জিরো পয়েন্টের দিকে আসতে থাকে।

মসজিদের ব্যবস্থাপনা কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আশ্রাফুল আলম গিটার জানান, ‘মসজিদ ও মন্দিরের ইতিহাস প্রায় ১৪৫ বছরের পুরোনো। ১৮৭৬ সালে ত্রিপুরার রাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর ফেনী শহরে মন্দির ও মসজিদের জন্য ৫০ শতাংশ করে জমি বরাদ্দ দেন। সে সময়ের টিনের ছাউনি থেকে আজকের কংক্রিটের ধর্মীয় উপাসনালয় দুটি গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ধর্মীয় সম্প্রীতির উদাহরণ হয়ে।

‘মাত্র কয়েক গজের ব্যবধানে একদিকে আজানের ধ্বনি, অন্যদিকে পূজা-অর্চনা দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার বন্ধনকে দৃঢ় করেছে প্রায় দেড় শ বছর ধরে। তবে গত শনিবারের ঘটনার পর কিছুটা হলেও আঁচড় লেগেছে এই সম্প্রীতি ও বন্ধনে।’

আশ্রাফুল আলম গিটার বলেন, ‘প্রকৃত মুসলমানরা এই হামলায় অংশ নেয়নি। কিছু বহিরাগত ও উচ্ছৃঙ্খল জনতা মন্দির ও আশপাশের এলাকায় দোকানে হামলা করে। সাময়িকভাবে কিছুটা প্রভাব পড়লেও দীর্ঘদিনের সম্প্রীতি নষ্ট হবার নয়।’

ফেনী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি শুকদেব নাথ তপন বলেন, ‘শায়েস্তা খাঁর আমল থেকে প্রতিষ্ঠিত মন্দির-মসজিদের সম্প্রীতি নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও গত শনিবারের হামলায় সেই প্রশ্ন উঠেছে, যেটা আমি ইতিবাচকভাবে দেখছি না। ১৬ অক্টোবর ফেনীর কেন্দ্রীয় জয়কালী মন্দিরে ব্যাপক ভাঙচুর হয়েছে। এ ছাড়া ফেনী শহরের ১৫টি হিন্দু দোকানেও লুটপাট চালানো হয়েছে। যারা হামলা-ভাঙচুর করেছে, সবাই বহিরাগত। তারা ভিন্ন কোনো উদ্দেশ্যে এই নাশকতা চালিয়েছে।’

ফেনী কেন্দ্রীয় বড় মসজিদ লাগোয়া তাকিয়া রোডে ১৯৭৩ সালের আগে থেকে ব্যবসা করছে রেনু ট্রেডার্সের মালিক নয়ন পালের পরিবার। নয়ন পাল বলেন, ‘গত শনিবারের আগেও এখানে মনে হয় হিন্দু-মুসলিমে কোনো তফাৎ ছিল না। মসজিদে নামাজ শেষে অনেক মুসলিমও আমাদের দোকানে কেনাকাটা করতেন, হিন্দুরা তো আসতেনই। তবে শনিবার যে আক্রমণ করা হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর, তাতে করে সম্পর্কে তো একটু হলেও চিড় ধরবে। অথচ শত বছরের ইতিহাসে ফেনীতে এমনটা হয়নি।’

মসজিদ মার্কেটের পাটোয়ারী ফ্যাশনের মালিক নুরুল হুদা জানান, তিনি এখানে কখনও হিন্দু-মুসলমানে ভেদাভেদ দেখেননি। হিন্দুরাও তার দোকানে আসতেন নিয়মিতই। শনিবারের ঘটনা কিছুটা হলেও মনে দাগ কেটেছে। এ ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা তার কাছেও নেই।

জেলা প্রশাসক ও মসজিদ কমিটির সভাপতি আবু সেলিম মাহমুদ উল হাসান বলেন, ‘যারা এ কাজ করেছে তারা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে করেনি। একটি পক্ষ দেশকে অস্থিতিশীল করতে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। এটা কোনো ধর্মীয় বিরোধ নয়। একটি দুষ্কৃতকারীচক্র ঘটনার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তবে এই সম্প্রীতি ছিল, আছে, থাকবে। এই ঘটনা বেদনার।’

জয়কালী মন্দির কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিল্পকলা একাডেমির সদস্য সমরজিৎ দাস টুটুল বলেন, ‘কয়েক ঘণ্টার হামলায় শত বছরের ঐতিহ্যের বন্ধন যেন ম্লান হয়ে গেছে। এখানে মন্দিরে প্রতিবছর পূজার সময় মসজিদ থেকে নামাজের সময়সূচি নিয়ে আসা হতো। নামাজ ও আজানের সময় পূজার কার্যক্রম বন্ধ রাখা হতো। একই রকম সহাবস্থান ছিল মসজিদের দিক থেকেও। অথচ এক দিনের ঘটনায় মনে যে দাগ কেটেছে, সেটা কীভাবে মুছবেন?’

টুটুল আরও বলেন, ‘বলা হচ্ছে এখন পরিস্থিতি শান্ত। আদতে শান্ত হলেও মন কি আর শান্ত হয়েছে? হিন্দুরা তো ভালো নেই, মুসলমানদের মনেও এই ঘটনা দাগ কেটে গেছে। তারাও তো আমাদেরই ভাই। দশমীর বিসর্জন কোনোভাবে পার করলেও বুধবারের লক্ষ্মীপূজায় তাদের কোনো আনন্দ নেই। হারিয়ে ফেলেছেন প্রাণচাঞ্চল্য।

‘মন্দির পূজা-অর্চনার জায়গা, অথচ সেখানে পুলিশ বসে পালাক্রমে পাহারা দিচ্ছে। এটিও কি সম্ভব? তবে এই সম্প্রীতি আবারও ফিরে আসবে বলে আমি আশা করি।’

সমরজিৎ দাস শনিবার রাতের ঘটনার সাক্ষী। এশার নামাজের পর থেকে শুরু হওয়া হামলা শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলেন মন্দিরের ভেতরেই।

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা মাত্র ৮ জন মানুষ ছিলাম ভেতরে। মসজিদের সামনে বিকেলের পর থেকে থমথমে পরিবেশ ঘোলাটে হতে থাকে। এশার নামাজের পর মসজিদের ছাদ ও মিনারের ওপর থেকে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারা হয়। একপর্যায়ে কলাপসিবল গেটের নিচ দিয়ে পেপার ছড়িয়ে দিয়ে ওপর থেকে প্লাস্টিক বোতলের মধ্যে আগুন দিয়ে পেট্রল ছুড়ে মারা হয়। কোনো রকমে পানি দিয়ে আগুন নিভিয়েছি। পরে ইট-পাটকেলের আক্রমণের চোটে মন্দির অফিসের দেয়ালের পেছনে আশ্রয় নিই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের গর্বের মসজিদ-মন্দিরের সহাবস্থান এক দিনেই প্রশ্নের মুখে পড়ল। আমাদের পুরোহিত বিষ্ণুপদ চক্রবর্তীকে যেরকমভাবে ধুতি খুলে, কালেমা পড়তে বাধ্য করা হলো, তা তো একাত্তরকেও হার মানায়। সম্পূর্ণ পূর্বপরিকল্পিত এই হামলায় আমাদের নিয়ে খেলাধুলা হচ্ছে, আমরা এখন দাবার ঘুঁটি।’

তাকিয়া সড়কের আরেক দোকানদার বিষংকর পাল। তার পরিবার প্রায় ৫৮ বছর ধরে ব্যবসা করছে। তিনি জানান, শুধু মন্দিরেই হামলা হয়নি, মসজিদের পাশের তাকিয়া রোডে বেছে বেছে প্রায় ১৬টি হিন্দু দোকান ভেঙে মালপত্র লুটপাট করা হয়েছে। তার দোকানের নগদ ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকাসহ লুট হয়েছে ৫ লাখ টাকার পণ্য।

ওই দোকানের কর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শী শিমুল দাস জানান, রাত সাড়ে ৮টার দিকে হঠাৎ পাশের শুঁটকির দোকানে হামলা দেখে দোকান বন্ধ করে কাছেই আশ্রয় নেন তিনি। দূর থেকে শস্যপণ্য ও মালপত্র লুট করে নিয়ে যাওয়া দেখেন, প্রাণের ভয়ে বাধা দেয়ার সাহস করেননি। এদের প্রত্যেকেই ১৮-২১ বছর বয়সী যুবক। এদের কেউই পরিচিত নয়। তারা শুধু হিন্দু দোকানেই আক্রমণ করেছে।

ট্রাংক রোডের মোড়ে পুলিশ থাকলেও অনেকবার ৯৯৯-এ কল করার পরও পুলিশের কোনো সদস্য দোকানে হামলার সময় তাকিয়া সড়কের দিকে আসেনি। অনেকে বাসার সিসিটিভির ফুটেজে নিরুপায় বসে দোকান লুট, ভাঙচুর দেখেছেন।

বাঁশপাড়া দুর্গাপূজা মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ দে জানান, শুধু প্রথম দুই দিন ঠিকমতো পূজা করেছেন তারা। বাকিটা সময় কাটিয়েছেন আতঙ্কে। বাড়ির নারী সদস্যদের বাইরে না যেতে বলেছেন।

জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ সভাপতি এবং সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শুসেন চন্দ্র শীল জানান, শনিবার আসরের নামাজের পর কেন্দ্রীয় বড় জামে মসজিদের পাশের জয়কালী মন্দির থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি প্রতিবাদ মিছিল করার কথা ছিল। একই সময়ে আসরের নামাজ হওয়ায় অনেক দেরিতেই মিছিলের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ওদিকে মসজিদের সামনে সাধারণ মুসল্লিদের ব্যানারে জড়ো হয় দুই শতাধিক তরুণ-যুবক। এদের বেশির ভাগই এখানে নিয়মিত নামাজ পড়ে না।

তিনি বলেন, পরে পুলিশের অনুরোধে প্রতিবাদ মিছিল সরিয়ে নেওয়া হলেও এই তরুণ-যুবকরা না সরায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। একই সময়ে আওয়ামী যুবলীগের একটি মিছিল এসে মুসল্লিদের বাধা দিতে চাইলে ইট-পাটকেল নিক্ষেপে দুই পক্ষের সংঘর্ষ বেধে যায়। তবে এতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ-যুবলীগ বেশি আহত হয়।

শুসেন চন্দ্র শীল বলেন, এশার নামাজের পরপরই এসব তরুণ-যুবক দলে দলে মসজিদের ছাদে উঠে পাশের মন্দিরে হামলা করে। কিছু লোক পাশের দোকান ও মন্দিরগুলোতে হামলা চালায়। মসজিদের ছাদ থেকে আক্রমণ করায় বেশি ক্ষতি হয়েছে।

এ বিভাগের আরো খবর