কুমিল্লা বিভাগের নাম ‘কুমিল্লা’ রাখার শত অনুনয় সত্ত্বেও নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি জানিয়ে দিলেন, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা/ তোমার আমার ঠিকানা’-এর অনুপ্রেরণায় এবং দেশের প্রধান নদী হিসেবে এই বিভাগের নাম মেঘনা রাখা হবে।
কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের নবনির্মিত অফিস ভবনের উদ্বোধনী আয়োজনে বৃহস্পতিবার দুপুরে গণভবন প্রান্ত থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন সরকার প্রধান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কুমিল্লাকে বিভাগ হিসেবে ঘোষণার দাবি রাখেন কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার। তার দাবির সঙ্গে সহমত জানান অনুষ্ঠানে উপস্থিত জেলার সর্বস্তরের নেতা-কর্মীরাও।
তাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিভাগের ব্যাপারে আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি দুটি বিভাগ বানাব দুটি নদীর নামে। একটা পদ্মা, একটা মেঘনা। এই দুই নামে দুইটা বিভাগ করতে চাই।’
প্রধানমন্ত্রীর কথা শেষ না হতেই বাহাউদ্দিন বাহার বলেন, ‘আপা, কুমিল্লা নামে করেন।’
উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ওই কু নাম দেব না আমি। কুমিল্লা দেব না আমি।’
সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে আবারও অনুরোধ জানাতে থাকেন বাহার।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি কুমিল্লা নামে দেব না। কারণ তোমার ওই কুমিল্লা নামের সঙ্গে মুশতাকের নাম জড়িত। সেজন্য আমি দেব না। ওই কুমিল্লা নাম নিলেই তো মুশতাকের কথা মনে উঠে।’
এবার বাহার বলেন, ‘কোনো কুলাঙ্গারের নামে দেশের পরিচয় হয় না আপা। বাংলাদেশের পরিচয় বঙ্গবন্ধুর ওপর, মুনায়েম খানের ওপর না। বঙ্গবন্ধুকেই চেনে সারা বিশ্ব। বাংলাদেশ চিনত না। বলত, শেখ মুজিবের দেশ।’
এ অবস্থায় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা বাহারকে থামিয়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সরকার প্রধান বলেন, ‘তাহলে তুমি বলো, কুমিল্লা নাম হবে কেন? চাঁদপুর বলে আমার নাম হবে, নোয়াখালী বলবে আমাদের নাম…নোয়াখালী সব থেকে পুরনো একটা… কুমিল্লা তো ত্রিপুরার একটা ভগ্নাংশ।’
তারপরও বিরোধিতা করতেই থাকেন বাহাউদ্দিন বাহার।
এবার প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি ফরিদপুর বিভাগ করব পদ্মা নামে।’
কুমিল্লা নামে বিভাগ হোক এটা ৫০ লাখ মানুষের দাবি জানিয়ে বাহার বলেন, ‘ফরিদপুর বিভাগ কী হবে জানি না, কিন্তু আমাদেরটা আমাদের নামে দেন।’
তবে কুমিল্লা আওয়ামী লীগ নেতারা এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলেও নিজের অবস্থানে অনড় ছিলেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমি ফরিদপুর বিভাগ করব পদ্মা নামে। ফরিদপুর নামও দিচ্ছি না। কুমিল্লা বিভাগ হবে মেঘনা নামে। কারণ, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা/ তোমার আমার ঠিকানা’ এই স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ করেছে, বিজয় অর্জন করেছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ (কুমিল্লা) নামে অন্য জেলাগুলো আসতে চায় না।’
বাহারের যুক্তিতর্কের কারণে একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আচ্ছা তুমি সবার কাছ থেকে লিখিত নিয়ে আস। তোমাকে দায়িত্ব দিলাম, সবার কাছ থেকে মানিয়ে নিয়ে আস, যাও।’
বাহার বলেন, ‘আপা, আপনি দিলেই মানবে। আপনি মুখ দিয়ে বললেই হয়ে যাবে, আপা।’
আরও কিছুক্ষণ ধরে কুমিল্লা নামেই বিভাগ করতে অনুনয় চালিয়ে যান সংসদ সদস্য বাহার।
শেষে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যদি বিভাগ চাও, আমি মেঘনা নামেই করে দিতে পারি।’
বাহার তবুও বলেন, ‘করজোরে অনুরোধ আপা।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মেঘনা পার হয়েই তো যেতে হয় কুমিল্লা। আর পদ্মা পার হলেই তো ফরিদপুর।’
বাহার আবার বলেন, ‘আপা, আমরা আপা হিসেবেই চাই। প্রধানমন্ত্রী না। আপা, আপনি আমাদের আপা, এই হিসেবেই চাই। বঙ্গবন্ধুকন্যা। বঙ্গবন্ধুকন্যা ফিরিয়ে দেবে না বাহারকে।’
এসময় নেতা-কর্মীকে হাততালি দিয়ে সমর্থন জনান সংসদ সদস্য বাহারকে।
বাহার বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকন্যা ফেরত দিতে পারবে না বাহারকে।’
প্রধানমন্ত্রী জানান অন্য জেলাগুলো এমন নাম মানবে না। তিনি বলেন, ‘তাহলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাম দিতে হবে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া চাচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নাম হোক। ফেনী চায় ফেনী নাম হোক। চাঁদপুর নামটা আরও সুন্দর। চাঁদপুর চায়, চাঁদপুর হোক।’
বাহার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল কুমিল্লার সাব ডিভিশন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার প্রস্তাব রাখলাম। যদি পছন্দ হয় ভালো, না হলে হবে না। আমি কী করব।’
বাহার আবার বলেন, ‘আপনি এভাবে বললে আমরা কোথায় যাব, কার কাছে যাব?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দুইটা বড় নদী, নদীর নামটা সম্মান দিয়ে রাখতে চাই। যে স্লোগান দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে সেই স্লোগান দিচ্ছি, আবার কী?’
বক্তব্য শেষ করার আগ মুহূর্তেও ‘মেঘনা’ নামে কুমিল্লা বিভাগের নামকরণের প্রস্তাবটা সবাইকে গ্রহণ করার আবেদন জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী পদ্মা ও মেঘনা নামে দুটি বিভাগ ঘোষণা হলে দেশে মোট বিভাগ হবে ১০টি। দেশের সবশেষ বিভাগ হয় ময়মনসিংহ, ২০১৫ সালে।