আন-আইডেন্টিফাইড ফ্লাইং অবজেক্ট বা ইউএফও নিয়ে মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। নিরন্তর গবেষণা চলছে কথিত এইসব ভিনগ্রহবাসীদের বাহনগুলো নিয়ে। নিউজল্যান্ডের সাবেক এক শখের গণিতবিদ ছক কষে বের করেছিলেন ইউএফও দেখা যাওয়ার প্যাটার্ন। তার ওই তত্ত্ব টেনে এনেছে বহু প্রাচীন একটি ধারণাকে - ক্রিস্টাল পৃথিবীর ধারণা। পেন্টাডোডেকাহেড্রন ও হারমোনিক গ্রিড নিয়ে বিশেষ এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ভিত্তিক সাইট ‘ভাইস’। নিউজবাংলা পাঠকদের জন্য সেটি অবলম্বনে লিখেছেন রুবাইদ ইফতেখার।
১৯৭৩ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের ‘কেমিস্ট্রি অ্যান্ড লাইফ’ জার্নালে চমকপ্রদ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়; শিরোনাম ছিল ‘পৃথিবী কি একটি বিশাল ক্রিস্টাল (স্ফটিক)?’
প্রতিবেদনে বেশ গভীর অনুসন্ধান করা হয়। সেটা অনেকটা এমন ছিল: পিথাগোরাস পেন্টাডোডেকাহেড্রন নামের একটি মিশ্র-জ্যামিতিক আকার নিয়ে মজে ছিলেন। এ বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক একে বলতেন ‘মহাজাগতিক গোলক’। প্লেটোও এই আকৃতি নিয়ে আগ্রহী হন ও এর নাম দেন ‘আসল পৃথিবী’। মহাবিশ্ব সৃষ্টির ভিত্তি হিসেবে এ জ্যামিতিক আকারটিকে ধরে নিয়েছিলেন দুজন। পিথাগোরাস, প্লেটো ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মের বুদ্ধিজীবীর পাশাপাশি ও অতিন্দ্রীয়বাদের (মিসটিসিজমের) অনেকগুলো ধারায় এই পেন্টাডোডেকাহেড্রনের আসল শক্তিকে গোপন রাখার বিষয়ে জোর দেয়া হয়।রাশিয়ার প্রতিবেদনটিতে দাবি করা হয় যে, সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী ছিল পেন্টাডোডেকাহেড্রনের কৌণিক মাত্রার একটি বৃহৎ ক্রিস্টাল। কালক্রমে গ্রহটি শেষ ক্ষয়ে ক্ষয়ে একটি গোলকের আকার নেয়। প্রতিবেদনে এই তত্ত্ব দেয়া হয়, ‘পৃথিবী নিজেই একটি জ্যামিতিকভাবে নিয়ন্ত্রিত দ্বৈত গ্রিড তৈরি করে।’ প্রথম গ্রিড ১২টি পঞ্চভুজাকৃতির খণ্ড দিয়ে তৈরি। দ্বিতীয়টি ২০টি সমবাহু ত্রিভুজের সমন্বয়ে তৈরি।
রাশিয়ান গবেষণায় বের করা হয় যে এই স্ফটিক গ্রিডটি পৃথিবীর সমুদ্রের তলের উঁচু-নিচু, ফাটল ও মহাসাগরের নিচে পর্বতসারির সঙ্গে কোনো কোনো জায়গায় মিলে গেছে। মজার বিষয় হলো, ত্রিভুজের একটি শীর্ষবিন্দু গিয়ে পড়েছে কুখ্যাত বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলে। কয়েকটি গেছে প্রাচীন পেরুতে, ইস্টার আইল্যান্ডে ও গিজার পিরামিডে। এই ছেদবিন্দুগুলোতে ভূমিকম্প/আগ্নেয়গিরি, আজব আজব সব জন্তুজানোয়ারের বিচরণস্থল, চরম বায়ুমণ্ডলীয় চাপ, খনিজ আকরিক ও লোহার সঞ্চয় ও স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চতর চুম্বকত্বসহ অন্যান্য অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণের দৃষ্টান্ত দেখা যায়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ‘পৃথিবীর জৈবমণ্ডলের অংশ হিসেবে মানুষও ক্রিস্টাল পৃথিবীর প্রভাবমুক্ত নয়’।
এ রকম একটি অদ্ভুত ধারণার ক্ষেত্রে রাশিয়ান ভূতত্ত্ববিদরা একা ছিলেন না। অর্ধেক পৃথিবী দূরত্বে থাকা ব্রুস ক্যাথি নামে নিউজিল্যান্ডের এক ব্যক্তি একই ধরণের গ্রিড তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, তার এই তত্ত্ব দিয়ে প্রায় সব কিছু ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
ইউএফও দেখা যাওয়ার নির্দিষ্ট প্যাটার্ন
ক্যাথি একাধারে ছিলেন নিউজিল্যান্ডের একটি এয়ারলাইনের পাইলট, শখের গণিতবিদ ও ইউএফও তত্ত্বের একজন বিশ্বাসী। ১৯৬৮ সালে একটি অদ্ভূত পর্যবেক্ষণ হাজির করেন তিনি। বিশ্বজুড়ে ইউএফও দেখার রিপোর্ট যাচাই করার পর ক্যাথি নিশ্চিত হন যে তিনি এগুলোর দেখা যাওয়ার স্থানের একটি ভৌগোলিক প্যাটার্ন সনাক্ত করেছেন।তার জনপ্রিয় কয়েকটি বই ‘হারমোনিক সিক্সনাইনটিফাইভ’, ‘দ্য এনার্জি গ্রিড’ ও ‘দ্য পালস অফ দ্য ইউনিভার্স’-এ তিনি লেখেন, ‘প্রথমে ইউএফওর কেসগুলো এত ছড়ানো-ছিটানো ছিল যে, তাদেরকে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটা ছকে আনা প্রায় অসম্ভব ছিল।’ তবে ক্যাথি নিশ্চিত ছিলেন যে একটা প্যাটার্ন অবশ্যই আছে। যে কারণে তিনি তার তত্ত্ব নিয়ে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আশা করছিলেন জ্যামিতিক পয়েন্টের জটলার মধ্যে ইউএফও কার্যকলাপের অন্তর্নিহিত কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে।
নিউজিল্যান্ডের শখের গণিতবিদ ব্রুস ক্যাথি। ছবি: সংগৃহীত
আধুনিক কম্পিউটারের সাহায্য ছাড়াই তিনি ইউএফও দেখার স্থানগুলোর প্রক্রিয়ার একটি প্যাটার্ন বের করেন। প্রথমে তিনি পৃথিবীর একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের একটি প্যাটার্ন প্রতিষ্ঠান করেন, যাকে মূল ধরে তার পক্ষে ‘অনুলিপি বা অনুমানের ভিত্তিতে বাকিগুলোকেও খুঁজে বের করা সম্ভব’ হবে। তবে কাজটি সঠিকভাবে শুরু করতে ক্যাথির দরকার পড়ে প্রচুর ডেটা।
দ্য এনার্জি গ্রিড বইতে ক্যাথি জানান, ১৯৬৫ সালের এপ্রিলে তিনি ইউএফও দেখার এক ‘স্বর্ণখনির’ সন্ধান পান। তিনি পত্রিকায় দেখতে পান, নিউজিল্যান্ড সায়েন্টিফিক অ্যান্ড স্পেস রিসার্চ নামের এক সংস্থা নতুন সদস্য খুঁজছে। তিনি ওই সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করেন ও দেখেন তাদের কাছে প্রচুর পরিমাণ তথ্য অত্যন্ত চমৎকারভাবে গোছানো আছে। ক্যাথি তাদের কাছে ১২ বছর ধরে সংগ্রহ করা ২৫টি দেশের তথ্য পান। ক্যাথিকে তারা অবসর সময়ে এগুলো নিয়ে গবেষণার জন্য আমন্ত্রণ জানায়।
নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে একই ধরনের ইউএফওর দেখা যাওয়ার বর্ণনা আছে এমন সব রিপোর্টের তালিকা নিয়ে ক্যাথি দ্রুত কাজ শুরু করেন। ইউএফওগুলো দেখা যাবার সময়কে আরও ছোট করে আনেন ক্যাথি। স্থানীয় সময় রাত পৌনে ১০টা থেকে পরের ১৫ মিনিটের তথ্য বাছাই করেন তিনি। হাতে থাকা এই ডেটা পয়েন্টগুলোর সঙ্গে ক্যাথি টানা কয়েক সপ্তাহ ইউএফও ট্র্যাক লাইন হিসেব করেন ও সারা বিশ্বে অন্যান্য গবেষণার সঙ্গে তার হিসেবকে ক্রস-রেফারেন্স করেন।
নিউজিল্যান্ডের মানচিত্রের ওপর ক্যাথি একটি গ্রিড কল্পনা করেন। গ্রিডে উত্তর দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম দিকে ৩০ মিনিটের চাপ হিসেবে করে অক্ষাংশ নেয়া হয়। এর অর্থ হচ্ছে, পৃথিবী পৃষ্ঠের বক্রতার সঙ্গে সমান্তরালে থেকে কেউ ৩০ মিনিটে নির্দিষ্ট দিকে যেটুকু দূরত্ব অতিক্রম করবেন সেইটুকু। হতবাক হয়ে তিনি লক্ষ্য করেন যে, তার ডেটা সেটের ১৬টি স্থির ও ১৭টি চলমান। ইউএফওর দেখা যাওয়ার সবগুলো স্থান তার কল্পিত গ্রিডের ছেদ বিন্দুতে নিঁখুতভাবে বসে গেছে।
ক্যাথি তার তত্ত্ব নিয়ে আরও অনেক দূর যেতে চেয়েছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল, এই গ্রিডটিকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়া এবং ইতিহাসের প্রতিটি ইউএফও দর্শনের ঘটনাকে ট্র্যাক করা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ও রাশিয়ান রিপোর্ট থেকে আংশিক অনুপ্রাণিত হয়ে ক্যাথি তার গ্রিডের হিসেবে মিলে যাওয়া প্রাকৃতিক ঘটনাগুলির তথ্য জোগাড় করেন। তার কাজগুলো একেবারে প্রান্তিক, এমনকি ইউএফও কমিউনিটিতেও এটি প্রান্তিক হিসেবে বিবেচিত। কীভাবে রাশিয়ান ওই গবেষণাটি বিজ্ঞানী সমাজ ও এর বাইরের গবেষকদের প্রভাবিত করেছে, সেটা বোঝা যায় ক্যাথির কাহিনী থেকে। তার কাজ থেকে এটাও প্রমাণ হয় যে অপ্রচলিত ধারার বিজ্ঞান থেকেও চমকপ্রদ সত্যের টুকরো বেরিয়ে আসতে পারে।
মহাসাগরের একটি অদ্ভূত আবিষ্কার ক্যাথিকে তার গবেষণা চালিয়ে নেয়ার এক নতুন পথের সন্ধান দেয়।
১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট আমেরিকার একটি জাহাজ ‘এলটানিন’ দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলবর্তী সমুদ্র তলদেশের গবেষণা কাজে ব্যস্ত ছিল। ওই সফরে পানির নিচের বেশ কিছু ছবি নেয়া হয় ও পরে ডেভেলপ করা হয়। ওই ছবিগুলোর একটিতে অনেকগুলো ক্রসবারসহ একটি সঠিক মাপের অ্যান্টেনা দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখা যায়।
বস্তুটির অবস্থান ছিল অক্ষাংশ 59°08' দক্ষিণ, দ্রাঘিমাংশ 105° পশ্চিমে। ক্যাথির মতে সমুদ্রপৃষ্ঠের সাড়ে ১৩ হাজার ফুট নিচে এই ‘লোহার কারিগরি’ কোনো মানুষের পক্ষে বসানো সম্ভব না। দ্য নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড পত্রিকা একে দ্য এলটানিন অ্যান্টেনা নাম দেয়। পরবর্তীতে এই নামটিই পরিচিত হয়ে ওঠে।
এটা উল্লেখ করা দরকার যে, এলটানিন অ্যান্টেনার সঙ্গে বিরল প্রজাতির এক ধরনের সামুদ্রিক মাংশাসী স্পঞ্জ ক্ল্যাডরজিয়ার (Cladorhiza concrescens) অদ্ভূত মিল রয়েছে। ক্যাথি নিজেও এই মিলের কথা স্বীকার করেছেন, তবে ২০১৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করতেন যে, আসল সত্যকে ঢাকতেই এই স্পঞ্জের কথা বারবার বলা হচ্ছে।
এলটানিন জাহাজের তোলা ‘অ্যান্টেনার’ ছবি। ছবি: সংগৃহীত
দ্য এনার্জি গ্রিড বইতে ক্যাথি বলেন, এই আবিষ্কারে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এলটানিন অ্যান্টেনার কো-অরডিনেট, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ইউএফও দেখতে পাওয়া ও তার নিজের তৈরি গ্রিডের সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা শুরু করেন। তার এই গবেষণার খবর ছড়িয়ে পড়লে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে সহায়তা আসতে থাকে। সহায়তার বড় একটা অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও নিউজিল্যান্ডের অন্য পাইলটদের কাছ থেকে। এলটানিনের মতো একই মাপের অপরিচিত কিছু রেডিও ট্র্যান্সমিটারের কথা তারা রিপোর্ট করেন। অচেনা ধরনের ট্র্যান্সমিটারগুলোতে জালের মতো কাঠামো রয়েছে ও প্রতিটা বাহুর শেষে গোলাকার বৃত্ত।
ক্যাথি তখন এই অচেনা অ্যান্টেনাগুলো তার নিউজিল্যান্ডের ইউএফও মানচিত্রে যোগ করেন। ইউএফও দেখার জায়গাগুলোর সঙ্গে যোগ হয় মানুষের তৈরি ট্র্যান্সমিটিং স্টেশন, তালিকার বাইরের স্টেশন ও আমেরিকার সায়েন্টিফিক বেজ।
বাড়তে থাকা অ্যান্টেনার রিপোর্টের নেটওয়ার্কের সঙ্গে প্রতি অঞ্চলের হ্যাম রেডিও ইয়ারবুকের মিল খুঁজে পেলেও ক্যাথি কোনোভাবেই সরকারিভাবে এই ট্র্যান্সমিটারগুলো ব্যবহার বা বসানোর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছু জানতে পারেননি। তিনি তার বইয়ে লেখেন, ‘এই মুহূর্তে আমাকে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, একদল ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার গ্রিড সিস্টেম সম্বন্ধে আমার চেয়ে অনেক বেশি জানে।’
ক্যাথির জন্য পুরো বিষয়টা পরিষ্কার ছিল: গোপনে একটা ছোট গ্রুপ এরই মধ্যে এই গ্রিডের খোঁজ পেয়েছে ও একে অজানা কোনো কারণে ব্যবহার করছে। তার ধারণা পুরোপুরি ভুল ছিল না।
ক্রিস্টাল পেন্টাডোডেকাহেড্রন হিসেবে পৃথিবী
পৃথিবীর ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী গ্রিড সিস্টেম নিয়ে গবেষণায় কোনো ত্রুটি রাখেননি ক্যাথি। তার বিশেষ আগ্রহ ছিল রাশিয়ান প্রতিবেদনটি নিয়ে, আরও নির্দিষ্ট করে ধরলে ক্রিস্টাল গ্রিডের একটি ‘সংযোগস্থলে’, যেখানে গ্যাবনের ফ্রান্সেসভিল শহরের কাছে ওকলো এলাকায় একটি ‘প্রাকৃতিক পারমাণবিক রিয়্যাক্টর’ আছে।ফরাসি পদার্থবিদ ফ্রান্সিস পেরিঁ ১৯৭৩ সালে ভূগর্ভস্থ আইসোটোপের অনুপাতের হিসেব করে এই বিশেষ জায়গা খুঁজে বের করেন। ওকলোতে ১৬টি এমন স্থান রয়েছে, যেখানে ১৭০ কোটি বছর আগে স্বনির্ভর পারমাণবিক ফিশন ঘটেছিল এবং কয়েক লাখ বছর ধরে চলেছে এই প্রক্রিয়া। পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া পারমাণবিক রিয়্যাক্টর এটি।
ওকলোতে প্রাকৃতিক রিয়্যাকটর আবিষ্কার ও রাশিয়ান প্রতিবেদনে গ্রিড তত্ত্বের সমর্থন পাওয়ায় ক্যাথি নিজের গবেষণা আরও অপ্রচলিত ধারায় করা শুরু করেন। এবার তিনি কাজ শুরু করেন পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের পূর্বাভাস দেয়া নিয়ে।
নিউজিল্যান্ডের মানচিত্রের ওপর বসানো ব্রস ক্যাথির উদ্ভাবিত গ্রিড। ছবি: সংগৃহীত
ক্যাথি একটা বিষয়ে তার পুরো গবেষণায় অনড় থাকেন। তা হচ্ছে ‘পারমাণবিক কণার আপেক্ষিক গতির কারণে ভূ-পৃষ্ঠের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটা নির্দিষ্ট জ্যামিতিক বিন্দুতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে’ পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব। ক্যাথি আরও যোগ করেন, ‘পৃথিবী ও সূর্যের আপেক্ষিক গতি যে কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তে বিস্ফোরণে ব্যবহৃত ইউরেনিয়াম, প্লুটোনিয়াম, কোবাল্ট বা অন্যান্য যে কোনো পর্দার্থের অস্থায়ী কণাগুলোকে ব্যহত করবে।’
ক্যাথি তার পদ্ধতি ব্যবহার করে অনুকূল পারমাণবিক বিস্ফোরণের অবস্থা শনাক্ত করার জন্য ভবিষ্যতের পরীক্ষার স্থানগুলোকে নিয়ে বেশ কিছু পূর্বাভাস দেন, শুরুতে যার কয়েকটি মিলেও যায়। ১৯৬৮ সালের আগস্টে ইউএফও গবেষণা উপস্থাপনের জন্য তাকে অকল্যান্ডের রয়্যাল অ্যারোনটিক্যাল সোসাইটিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। উপস্থাপনার আগের দিন তিনি সোসাইটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে এক ডিনারে দেখা করেন। ওই সন্ধ্যায় কিছুক্ষণ পর তারা ক্যাথির পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন।ক্যাথির সঙ্গে যারা ওই দিন ডিনারে ছিলেন, তারা এই তত্ত্বে খুব একটা বিশ্বাস করেননি। চ্যালেঞ্জ হিসেবে ক্যাথিকে তারা ফ্রান্সের পরবর্তী পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার তারিখের ভবিষ্যদ্বাণী করতে বলেন। টেবিলে বসেই ক্যাথি হিসেব করে বের করেন যে পরবর্তী পরীক্ষা করা হবে ওই মাসেরই ২৪ তারিখে। ওই মাসের ২৪ তারিখে ফ্রান্সের প্যাসিফিক ক্যারিয়ার ব্যাটল গ্রুপ অপারেশন ক্যানোপাস পরিচালনা করে। এতে ফ্রান্স থার্মোনিউক্লিয়ার ডিভাইস (হাইড্রোজেন বোমা) বিস্ফোরণ ঘটানো বিশ্বের পঞ্চম পারমাণবিক শক্তি ক্ষমতাধর দেশে পরিণত হয়।
ক্যাথি তার নিজস্ব ধাঁচে পূর্বাভাসগুলো শঙ্কা ও আশ্বাসের মিশ্রণ হিসেবে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘বোমা বিস্ফোরণের জন্য প্রয়োজনীয় সৌর জ্যামিতি নির্দিষ্ট সময় না থাকলে রাশিয়ার কোনো টার্গেটে মিসাইল ছোড়া সফল করতে বহু ঘণ্টা, দিন ও সপ্তাহ লেগে যাবে।’
ক্যাথির জন্য পারমাণবিক বোমা আসলে একটি ‘স্পেসটাইম নির্ভর জ্যামিতিক ডিভাইস’। এর সফল বিস্ফোরণের জন্য প্রয়োজন মানচিত্র, পদার্থবিজ্ঞান ও ত্রিকোনোমিতি নির্ভর হিসেব।
বিশেষ করে ক্যাথি সব কিছুকে এক সুরে গাঁথার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়েছেন, প্রক্রিয়াটিকে ক্যাথি বলছেন হারমোনিক্স। কোনো জায়গার ‘হারমোনিক ভ্যালু’ সেখানে পারমাণবিক বিস্ফোরণ সম্ভব করে তোলে। শুধু পারমাণবিক বিস্ফোরণও নয়, এই তত্ত্ব দিয়ে ক্যাথির মতে পৃথিবীর সব ব্যাখ্যাতীত ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যাবে।
হারমোনিক গ্রিড
ক্যাথির মতে ইউএফওর দেখা যাওয়া ও প্রতিটা সফল পারমাণবিক বিস্ফোরণ আসলে কতগুলো ফ্রিকোয়েন্সির কারণে হয়, যেটার নাম তিনি দিয়েছেন হারমোনিক গ্রিড। এই ফ্রিকোয়েন্সিগুলো স্পেসটাইমের নির্দিষ্ট কোনো বিন্দুর আলো, অভিকর্ষ ও ভরের বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল, যে কারণে পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় নির্দিষ্ট সময়ে একেবারে অনন্য একটি কম্পণের স্বাক্ষর সৃষ্টি হয়, যাকে বলা হয় হারমোনিক।
ক্যাথি শত শত পৃষ্ঠা খরচ করেছেন এই হারমোনিক গ্রিডের মান বের করার জন্যে। তার গাণিতিক হিসাব নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে নানা তর্ক-বিতর্ক হলেও তার চিন্তার উৎস নিয়ে সবাই মোটামুটি পরিষ্কার। ক্যাথি মূলত অনুমান, হার, দূরত্ব এ রকম ভিন্ন ধরনের পরিমাপের ওপর নির্ভর ফরমুলাগুলো থেকে হিসেব করে একটা একক সংখ্যার ফল বের করতে চাচ্ছিলেন। আলোর গতি, অভিকর্ষের শক্তি ও ভর পরিমাপ করে কোনো একক পরিমাপে নিয়ে আসা ছোটখাট কোনো বিষয় নয়। এই সব বিচ্ছিন্ন ও ভিন্ন মানগুলিকে গড়ের মধ্যে নিয়ে আসার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় হচ্ছে হারমোনিক মিন ব্যবহার করা। একে সহজভাবে বোঝাতে গেলে বলতে হবে, হারমোনিক মিন হচ্ছে সম্পূরকের গড়ের সম্পূরক।
ক্যাথির হিসেবে লাইটের হারমোনিক ১৪,৩৯৯; পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের হারমোনিক ২,৫৪৫.৫ ও পৃথিবীর ভরের হারমোনিক ১৭,০২৫।
মূল বিষয়গুলো ঘটে হারমোনিকের ছেদবিন্দুগুলোতে। ওই বিন্দুগুলোতে:
১। স্পেস-টাইমের ভেতর এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে ভর স্থানান্তর করতে পারে।
২। ভর বেশি থেকে হ্রাসকৃত অবস্থায় পরিবর্তিত হতে পারে
৩। সঠিক প্রযুক্তি পেলে সময়ের সংকোচন ও প্রসারণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব
ঋণাত্মক বাস্তবতা
ক্যাথির দাবি, এই হারমোনিক পয়েন্টগুলো আসলে ঋণাত্মক বাস্তবতার একেকটি উৎসবিন্দু। বিষয়টা বুঝতে হলে ক্যাথির অ্যান্টি-ম্যাটার নিয়ে ভাবনাটা বুঝতে হবে। মহাশূন্যে একই ইলেকট্রনের ধনাত্মক ও ঋণাত্মক পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ম্যাটার ও অ্যান্টি-ম্যাটার সৃষ্টি হয়। মহাশূন্যে তরঙ্গ সর্পিলাকার গতিতে ঋণাত্মক ও ধণাত্মক পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যায়। ধনাত্মক পর্যায় যেটি পালস হিসেবে পরিচিত, সেখানে ম্যাটার তৈরি হয়। আর ঋণাত্মক পালসের ক্ষেত্রে তৈরি হয় অ্যান্টি-ম্যাটার।
আমাদের চেতনার সঙ্গে ম্যাটার ও অ্যান্টি-ম্যাটারের সম্পর্ক বোঝানোর জন্য সিনেমার তুলনা দিয়েছেন ক্যাথি। সিনেমার ফিল্মে প্রতিটি স্থির চিত্রকে তিনি বলছেন আমাদের শারীরিক অস্তিত্বের একক পালস। দুটি ফ্রেমের মাঝের পার্থক্যকে তিনি বলছেন অ্যান্টি-ম্যাটারের পালস। ফিল্মটিকে কোন প্রজেক্টর দিয়ে চালালে আমদের জন্য গতি ও সময় প্রক্ষেপণের বিভ্রম তৈরি হয়।
সিনেমা পর্দায় প্রজেকশনের কম্পাঙ্কের কারণে আমরা দুটি স্থিরচিত্রের মধ্যে পার্থক্য দেখতে পাই না। তবে প্রজেক্টরের গতি বাড়িয়ে কমিয়ে আমরা সিনেমার প্রদর্শিত ঘটনার সময় বাড়াতে বা কমাতে পারি। এই রূপকে আমাদের চেতনা হচ্ছে ফিল্ম প্রজেক্টর। ক্যাথির দাবি, মানুষ আসলে ‘দ্বৈত ধারার চেতনা’র অধিকারী।
ক্যাথির হিসেবে হারমোনিক গ্রিডের ছেদবিন্দুর বৈদ্যুতিক পালসের কম্পাঙ্ক বদলাতে থাকে। এটি আমাদের স্পেস-টাইমের অভিজ্ঞতায় প্রভাব ফেলার জন্য যথেষ্ট। আমাদের বাস্তবতার ধারণা এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে স্থানান্তর হয়। ক্যাথির মতে, ‘আমরা স্পেসে এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে স্থানান্তরিত হই, কিন্তু আমরা সেটা শারীরিকভাবে বুঝতে পারি না।’
বিতর্ক
ক্যাথির তত্ত্বকে প্রত্যাখানকারীদের সংখ্যা কম নয়, বরং সময়ের সঙ্গে সে সংখ্যা বাড়ছে। সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেন গণিত সমাজ। যারা ক্যাথির কাজকে পদার্থবিজ্ঞান কম ও ‘অদ্ভুতূড়ে গণিত’ বলে উড়িয়ে দেন। ক্যাথির কাজ নিয়ে আরেকটি সমালোচনা হচ্ছে যে তার গবেষণায়, ‘বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের চেয়ে দাবি বেশি’।ইউএফওনেট ডটআইটি তার হারমোনিক্স তত্ত্বকে বলেছে ‘তুচ্ছ কিছু সংখ্যাভিত্তিক খেলা, যেটার কোনো তাৎপর্য নেই।’ সফল পারমাণবিক বিস্ফোরণের জন্য ক্যাথির স্পেস-টাইমের শর্তগুলি সম্পূর্ণরূপে এখন অপ্রাসঙ্গিক। এই মুহূর্তে এটা বলা নিরাপদ যে, পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ক্ষেত্রে ভূগোল কোনো নির্ধারক ভূমিকা পালন করে না।