‘কী করি খামো, বাড়িত খাওয়ার কিচ্চু নাই, সোউগ (সব) নিয়ে গেইচে। আগুন দিয়ে পুড়ি দিচে, ছৈল পোইলরা কী খাইবে। হামরা চলমো কেমন করি....।
রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর উত্তরপাড়া হিন্দু পল্লিতে রোববার রাতে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে সব হারিয়ে নিঃস্ব সীতা রানী বুক চাপড়িয়ে এমন বিলাপ করছিলেন।হামলা ভাঙচুরের সময় জীবন বাঁচাতে ছেলের স্ত্রীসহ পরিবারের আরও তিন সদস্য নিয়ে বাড়ির পাশে ধানক্ষেতে লুকিয়ে ছিলেন তিনি।সীতা রানী বলেন, ‘যখন হামলা করে তকন হামরা বাড়িঘর ছাড়ি পালায়া যাই। আইতোত আসি দেখি কিচ্চু নাই। বেটা (ছেলে) জমি বন্দকের ৮০ হাজার টাকা ঘুরি (ফেরত) নিয়ে আচচিল সেটা নিয়ে গেইচে, বউয়ের সোনার গয়না নিয়ে গেইচে, বাড়ির হাঁড়িপাতিল ভাঙ্গি ফেলছে, ছাগল দুইটা ছিল তাও নিয়ে গেইচে। অ্যালা আইতোত (রাতে) খামো কী, বাড়িত খাবার কিচ্চু নাই বাবা....।’
রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর উত্তরপাড়া হিন্দুপল্লিতে রোববার রাতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা
তার বৃদ্ধ স্বামী অনুকুল চন্দ্র দাস বয়সের ভারে ন্যুব্জ। আয়ে সক্ষম একমাত্র ছেলে সমরেশ চন্দ্র দাস। পুঁজি হারিয়ে এখন নিঃস্ব তিনি।রাত সাড়ে ৯টার দিকে ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে রামনাথপুরের উত্তরপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে উগ্রপন্থি দুর্বৃত্তরা। এ সময় প্রাণ বাঁচাতে সীতা রানীর মতো অন্যরাও হামলার সময় বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছিলেন বাড়ির পাশের ধানক্ষেত, বাঁশঝাড়ে।
পুষ্প রানী বলেন, ‘সন্ধ্যায় পাকশাক (রান্না) করি আর পুরুষ লোকেরা বাজারে গেইচে। যখন ওই পাকে (দক্ষিণপাড়া) একটা গাড়ি আইসলো কখন, কই অ্যাম্বুলেন্সে ক্যানে আসিল। একটু পর শুনি বাড়িঘরে আগুন দিতোছে। অমনি সব ছাড়ি পালাইছি।’
পুষ্পিতা বলেন, ‘আমার বেটির (মেয়ের) বিয়ে হয়েছে কয় মাস হলো। ঢাকাত গেইচে। তার জন্য এক ভরি স্বর্ণ বানা আচে নিয়ে যায় নাই, সেইলাও নিয়ে গেইচে। অ্যালা বেটিক সেই স্বর্ণ দিমো ক্যামন করি। স্বর্ণ দিবের না পাইলে কি সংসার হইবে। হামরা কোনো দিন আর দিবের পামো না।’
শরত চন্দ্র দাস বলেন, ‘রোববার দুপুরের পর থাকি মেলা মানুষ খালি মোটরসাইকেল দিয়ে যায়-আর আইসে। হামরা কই এত মানুষ ক্যা আইজ এই দিকে। তারপর হামার এত্তি আসিল।’
রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুর উত্তরপাড়া হিন্দুপল্লিতে রোববার রাতে হামলা,ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা
তিনি বলেন, ‘পোরথমে হামার বাড়িত হামলা করচি। ভয়োত বাড়ি ছাড়ি পালাইচি। আগোম হামার বেটার বউ গেইচে পরে হামি কোনোমতে পালে আচিলোং। ঘর-বাড়ি যায় যাক বাচি তো আচি...।’হামলার বর্ণনা আর ক্ষতির বর্ণনা এভাবেই দিচ্ছিলেন ক্ষতিগ্রস্তরা।এ নিয়ে কথা হয় রামনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাদেকুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঘটনা শোনার পর আমরা প্রশাসনের লোকজনসহ আসছিলাম। হঠাৎ এত লোক এভাবে নিরীহ মানুষের ওপর হামলা চালাবে তা আমার বিশ্বাস হয় না। এই হামলা দেখে মনে হয়েছে একাত্তর সালের যুদ্ধ। পাকিস্তানি বাহিনী যেমন করি বাড়িঘর লুট করছে ঠিক অমন করেই বাড়িঘরে হামলা করা হয়েছে।’
আগুনে বাড়িঘর পুড়ে গেছে অনুকুল চন্দ্র দাসের
সোমবার দুপুরে রংপুর জেলা ও নগর আওয়ামী লীগ নেতারা ঘটনাস্থলে যান। তারা ক্ষতিগ্রস্তদের খাবার ও কাপড় বিতরণ করেন।বিকেলে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা রাশেক রহমান ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের টিন ও খাদ্যসামগ্রী দেন। এ ছাড়া রংপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খাবার বিতরণ করা হয়েছে।ঘটনাস্থলে অতিরিক্ত পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন রয়েছে।ফেসবুকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে রংপুরের পীরগঞ্জের রামনাথপুরে রোববার রাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুটি মন্দির ও বসতবাড়িতে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে ধর্মীয় উগ্রপন্থিরা। এতে ৬০টি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে।
রংপুর পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, ওই হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪৫ জনকে আটক করা হয়েছে। অনেককেই চিহ্নিত করা হয়েছে।