ক্রেতার অর্থের সুরক্ষায় নতুন নিয়ম করেও কমছে না দুশ্চিন্তা। ই-কমার্স থেকে পণ্য কিনে অর্থ পরিশোধের টেকসই উপায় বের করা যায়নি। সরাসরি ই-কমার্সে অর্থ না দিয়ে, গেটওয়ে বা এসক্রো পদ্ধতি চালু করা হলেও তাতেও নিশ্চিত হয়নি সুরক্ষা। শৃংখলা আনতে কি করা প্রয়োজন তাও বের করতে পারছে না বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক।
ই-কমার্সে পেমেন্ট নিয়ে তৈরি হয়েছে জটিলতা। ক্রেতার অর্থের সুরক্ষা দিতে চালু হয়েছে গেটওয়ে পদ্ধতি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ড নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। একাধিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অভিযোগ, গেটওয়েতে আটকে গেছে শত শত কোটি টাকা। অনুমোদন না নিয়ে ব্যবসা পরিচালনাসহ অর্থ পাচারের অভিযোগও উঠেছে দু’একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। তবে, গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান ফস্টারের দাবি, অর্থ তছরুপ হয়নি, ব্যাংকে জমা আছে গ্রাহকের অর্থ।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সহ-সভাপতি মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘এসক্রো পদ্ধতিই এখন পর্যন্ত শক্তিশালী পেমেন্ট করার উপায়। তবে এই পদ্ধতিতে কিছু স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার। তিনি বলেন, অটোমেশন না করা গেলে ধীর গতির কারণে পণ্য পৌঁছানো যাবে না।
গেটওয়ে পদ্ধতি কী?
নতুন নিয়মে, গ্রাহক পণ্যের জন্য অর্থ পরিশোধ করলে প্রথমে পাবে পেমেন্ট গেটওয়ে বা পিএসও। গ্রাহক পণ্য পেয়ে নিশ্চিত করার পর সার্ভিস চার্জ কেটে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেই অর্থ পরিশোধ করবে গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান। তারপর সেই টাকা পেয়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান উৎপাদনকে অর্থ পরিশোধ করবে। কিন্তু অর্থ পরিশোধ করা নিয়ে উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ।
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বলছে, গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান অর্থ ছাড় করছে না। আর গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের দাবি, দ্রুত সময়ে অর্থ ছাড় করা কঠিন।
কিউকমের অভিযোগ
ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কিউকম বরাবরই অভিযোগ করছে, গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান ফস্টার পেমেন্ট-এর কাছে আটকে আছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। যে টাকাগুলো গ্রাহক পণ্য কেনার জন্য এই প্রতিষ্ঠানকে দিয়েছে। কিন্তু ফস্টার পণ্য ছাড়ে সংকেত না দেয়ায় আটকে গেছে ডেলিভারি। ক্ষুব্ধ হচ্ছে গ্রাহক।
কিউকম-এর ডেলিভারি এক্সিকিউটিভ তানভীর চৌধুরী জানান, কিউকমের হাতে কিছুই নেই। ফস্টার সব অর্থ আটকে রেখেছে। তারা ছাড় করলেই পণ্য পাবে গ্রাহক।
অর্থ আছে বলছে ফস্টার
গ্রাহকের একটি অর্থও তছরুপ হয়নি বলে দাবি করেছে ফস্টার পেমেন্ট। প্রতিষ্ঠানের হেড অব পিআর মুনতাসির আহমেদ বলেন, ‘ফস্টার পেমেন্টের মাধ্যমে লেনদেনের একটি টাকাও দেশের বাইরে যায়নি। সব টাকা বিভিন্ন ব্যাংকের চলতি হিসাবে রক্ষিত আছে’।
পেমেন্ট সিস্টেমে গলদ আছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘এসক্রো পদ্ধতি গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষার একটা ভালো উপায়। পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবস্থায় ব্যাংকে টাকা রক্ষিত আছে। ভ্যারিফিকেশনের মাধ্যমে টাকা ছাড় করা হচ্ছে। টাকা অন্য কোনো দেশে যায়নি। দেশের ব্যাংকেই আছে। গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রেগুলেটর অথরিটির নির্দেশনায় টাকা বিতরণ করা হবে। ম্যানুয়াল পদ্ধতির কারণে সময় লাগছে। এ সময়টা আমাদের দিতে হবে।’
ছবি: সংগৃহীত
তিনি আরও বলেন, ‘ফস্টার পেমেন্টের সব কর্মকর্তা নিয়মিত অফিস করছেন। স্বচ্ছতার সঙ্গে আমরা কাজ করছি। নির্দশনা অনুযায়ী, নির্দিষ্ট ব্যাংক ও মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে টাকা দেয়া হবে। এ বিষয়ে আমাদের চুক্তি করা আছে। চুক্তি অনুযায়ী টাকা গ্রাহক পেয়ে যাবে। ম্যানুয়াল পদ্ধতির কারণে দেরি হচ্ছে।’
অনুমোদন ছাড়াই ব্যবসা
অভিযোগ উঠেছে ফস্টার পেমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নেয়নি। অভিযোগের সত্যতাও স্বীকার করেছে এই প্রতিষ্ঠান।
ফস্টার পেমেন্ট-এর হেড অব পিআর মুনতাসির আহমেদ বলেন, ‘২০১৬ সালে লাইসেন্স অনুমোদেনের জন্য আবেদন করা হয়। এটা চলমান প্রক্রিয়া। আশা করছি শিগগির লাইসেন্স পাওয়া যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এনওসির (নো অবজেকশন লেটার) মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।’
ফস্টারের সন্দেহজনক লেনদেন
ফস্টার পেমেন্ট লাইসেন্সের জন্য আবেদন করলেও এখনও তা বিবেচনায় নেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংসহ বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই লাইসেন্স দেয়া হয়নি। বিভিন্ন পর্যায়ে অনুসন্ধান শেষে সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগ উঠায়, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুরোধে গেল ৯ সেপ্টেম্বর ফস্টারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। শুধু ফস্টারই নয়, অন্য আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে উঠেছে অভিযোগ।
গেটওয়ে ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা
ই-পেমেন্ট গেটওয়ে বা ই-ওয়ালেট সেবা দিতে বাংলাদেশ পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেমস রেগুলেশনস-২০১৪-এর আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। এখন পর্যন্ত ৯টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে পেমেন্ট সার্ভিস অপারেটর বা ই-পেমেন্ট গেটওয়ে সেবার জন্য লাইসেন্স পেয়েছে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। আর চারটি প্রতিষ্ঠানকে পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার বা ই-ওয়ালেট সেবার জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি পেমেন্ট সার্ভিস অপারেটর হিসেবে লাইসেন্স পেয়েছে পোর্টোনিক্স লিমিটেড।
কে দেবে গ্রাহকের টাকা
প্রশ্ন হচ্ছে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেবে কে? কিউকম, আলিশামার্ট কিংবা ই-অরেঞ্জ। যারা এসব প্রতিষ্ঠানে অর্থ বিনিয়োগ করেছে তাদের টাকা কে ফেরত দেবে?
ই-কমার্স। ফাইল ছবি
গ্রাহকরা অভিযোগ করছে, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বলে টাকা আছে গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের কাছে। আর গেটওয়ে প্রতিষ্ঠান বলে ব্যাংকে আছে টাকা। তাহলে টাকা দেবে কে?
বাংলাদেশ ই-কমার্স কাস্টমার অ্যাসোসিয়েশন ও কিউকম কাস্টমার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা বলেন, গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এসক্রো সিস্টেম চালু করা হলেও এটিই এখন গ্রাহক ভোগান্তির মূল কারণ।
সরকারের তরফ থেকে গেটওয়ে প্রতিষ্ঠানের কাছে থাকা জমা অর্থ ফিরিয়ে দেবার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। অথবা আদৌ টাকা আছে কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে না।