রাজধানীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজাকে ঘিরে চলছে সাজ সাজ রব। মণ্ডপ, প্রতিমা তৈরির মাঠ ও মন্দিরগুলোতে এখন শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। একই সঙ্গে পূজা প্রস্তুত করা হচ্ছে উপলক্ষে অস্থায়ী মণ্ডপগুলোও, যা এখন প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
দুর্গোৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ হলো দেবী দুর্গার প্রতিমা। উৎসব সামনে রেখে প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পীরা। পূজা শুরুর আগেই মা দুর্গাকে তুলতে হবে মণ্ডপে। ইতোমধ্যে প্রতিমার কাঠামোর মাটির কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এরপর শুরু হবে রং ও সাজসজ্জার কাজ।
বাঙালি হিন্দুর উৎসবের ঢাকে কাঠি পড়া শুরু হয় ষষ্ঠীর আগে থেকেই। এবারের দুর্গাপূজা ১১ অক্টোবর (২৪ আশ্বিন) ষষ্ঠী পূজা দিয়ে শুরু করে ১৫ অক্টোবর (২৮ আশ্বিন) বিজয়া দশমী দিয়ে শেষ হবে। এর আগে পঞ্চমী থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসবের আমেজ। তবে ষষ্ঠী থেকেই কার্যত উৎসবের ঢাকে কাঠি পড়া শুরু হয়।
রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি পূজা উদযাপিত হয় পুরান ঢাকায়।
মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, শাঁখারিবাজার, তাঁতীবাজার, লক্ষ্মীবাজার, সূত্রাপুর, শ্যামবাজার, প্যারীদাস রোড, কলতাবাজার, মুরগিটোলা, মদনমোহন দাস লেন, বাংলাবাজার গোয়ারনগর, জমিদারবাড়ী, গেণ্ডারিয়া, ডালপট্টি এলাকার অলিগলিতে চলছে পূজার আয়োজন। ছোট-বড় বিভিন্ন মণ্ডপে শুরু হয়েছে মঞ্চ, প্যান্ডেল, তোরণ ও প্রতিমা নির্মাণের কাজ। বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন মৃৎশিল্পী থেকে শুরু করে কর্মচারী ও পূজা কমিটির সদস্যরাও।
এবার পুরান ঢাকায় নবকল্লোল পূজা কমিটি, শ্রীশ্রী শিব মন্দির, প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব, সংঘমিত্র পূজা কমিটি, শ্রীশ্রী রাধা মাধব জিউ দেব মন্দির, নতুন কুঁড়ি পূজা কমিটি, নববাণী পূজা কমিটি, রমাকান্ত নন্দীলেন পূজা কমিটিসহ আরও বেশ কিছু ক্লাব পূজা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রতিমা তৈরির মাঠ গুলো ঘুরে দেখা যায়, দেবী দুর্গা ও তার বাহন সিংহের প্রতিমাসহ তৈরি করা হচ্ছে যাকে বধের জন্য দেবীর আগমন সেই মহিষাসুরের প্রতিমা। এছাড়াও তৈরি হচ্ছে দেবী লক্ষ্মী, সরস্বতী, দেবতা কার্তিক, গণেশ, এবং তাদের বাহন পেঁচা, হাঁস, ইঁদুর আর ময়ূর।
প্রতিমা শিল্পীদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় পার করছেন তাদের কারিগররাও। বিভিন্ন জায়গার পাকা মন্দিরগুলো রং আর কাপড়ের বাহারি সাজে সাজছে। গান, নাচ, আরতি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটকের মধ্য দিয়ে বর্ণিলভাবে উৎসব পালনের জন্য চলছে বিরামহীন প্রস্তুতি।
শাঁখারিবাজার ও তাঁতিবাজারের মণ্ডপগুলোর প্রতিমার মাটির কাজ এরই মধ্যে প্রায় শেষ করে ফেলেছেন শিল্পীরা। মূর্তি গড়া শেষে রং তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হবে প্রতিমা। অর্ডার অনুযায়ী প্রতিমা গড়তে তাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই।
মৃৎশিল্পী ও তাদের সহযোগী কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতির কারণে সার্বিক প্রস্তুতি নিতে সময় কম পাওয়া গেছে। অল্প সময়ে তাই অধিক কাজের ব্যস্ততা চিন্তায় ফেলেছে তাদের। গত দেড় মাস ধরে শিল্পীরা দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন।
কারিগররা সাধারণত অজন্তা ধাঁচের মূর্তি বানিয়ে থাকেন। এগুলো ওরিয়েন্টাল প্রতিমা হিসেবে পরিচিত। অজন্তা ধাঁচের মূর্তির চাহিদা এখন বেশি। এ ধরনের মূর্তিতে শাড়ি, অলংকার ও অঙ্গসজ্জা সবই করা হয় মাটি ও রঙ দিয়ে। প্রতিমার শাড়ি, অলংকার, সাজসজ্জার উপকরণ আলাদাভাবে কিনে নিতে হয়।
মৃৎশিল্পীরা জানান, প্রতিবছরই তারা অধীর আগ্রহে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির কাজের অপেক্ষায় থাকেন। শুধুমাত্র জীবিকার জন্যই নয়। দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তাদের ধর্মীয় অনুভূতি, ভক্তি আর ভালোবাসা। দুর্গা মাকে মায়ের মতোই তৈরি করা হচ্ছে।
শাঁখারিবাজারের সংঘমিত্র পূজা কমিটির মণ্ডপে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরি করছেন মানিকগঞ্জের সুকুমার পাল। এবারের দুর্গোৎসবে আরও ছয়টি প্রতিমা বানাচ্ছেন তিনি।
সুকুমার পাল জানান, সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ চার লাখ টাকায় এসব প্রতিমা বানানো হচ্ছে।
শাঁখারিবাজার প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের পূজামণ্ডপের প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত মৃৎশিল্পী বলাই পাল।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এখনই বছরের সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত সময় পার করছি। পূজার আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি। তাই দম ফেলার সময়ও নেই। এর মধ্যেই দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির সব কাজ শেষ করতে হবে।’
কাজ শেষে বিশ্রামের ফাঁকে প্রতিমা শিল্পী পল্টন পাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যত কষ্টই করি না কেন, যখন দেবীকে তার স্বরূপে মণ্ডপে বসানো হবে তখন সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে। আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে যখন আমাদের তৈরি প্রতিমাকে সবাই পূজা করে। তখন নিজেকে আমার সফল, সার্থক মনে হয়।’
প্রতিমা তৈরিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা শিল্পী সুশীল নন্দী।
নিউজবাংলাকে তিনি জানান, জন্মের পর থেকেই এই কাজ দেখে ও শিখে আসছেন। স্বাধীনতার পর থেকে এ পেশায় যুক্ত আছেন। পূজার আয়োজনে দিন রাত মিলিয়ে প্রায় ১৬ ঘণ্টা কাজ করছেন সুশীল। তার অর্ডার পাওয়া সব প্রতিমা তৈরি কাজ প্রায় শেষ।
প্রতিমা তৈরির বিষয়ে সুশীল বলেন, ‘সাধারণত মাটিগুলো বিক্রমপুর ধামরাইল থেকে আনা হয়। আর আনুষঙ্গিক বাকি জিনিসপত্র শাঁখারিবাজারেই পাওয়া যায়। আমাদের কাছে অর্ডার আসে। অর্ডার অনুযায়ী আমরা প্রতিমা বানাই। কোনো বিশেষ নারীর মতো মুখমণ্ডল বানাতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। তবে তা ব্রাক্ষণরা ভালো বলতে পারবেন। আমরা সবসময় ডিজাইন অনুযায়ী কাজ করি।
করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেটি একবার লস হয়ে যায় সেটি ফিরিয়ে আনা কঠিন কাজ। প্রতিমা তৈরিতে অনেক সময় বাজেটের বেশিও খরচ হয় তখন আমাদের লস হয়। জিনিসপত্রের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে খরচ কত পড়বে বলা মুশকিল। তবুও কিছুটা লাভের আশায় কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
শাঁখারিবাজার ও তাঁতিবাজার থেকে পূজার সব ধরনের উপকরণ পাওয়া যায় বলে জানান তিনি।
চৈতন্য পাল নিউজবাংলাকে জানান, রোজ হিসেবে এখানে কাজ করছেন তিনি। দিনে ৮০০ টাকা মজুরি পান। কাজের অর্ডার পেলে তাকে ডাকা হয়৷ কাজ না থাকলে সাভারের ধামরাইলে মাটির হাঁড়িপাতিল বানান।
রাজধানীতে পূজা উদযাপনের সার্বিক বিষয়ে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির সদস্য রজত কুমার সুর নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঢাকা মহানগরে মোট ২৩৭টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা উদযাপন করা হবে। এর মধ্যে সূত্রাপুর থানায় সবচেয়ে বেশি ২৫টি মণ্ডপে, কোতোয়ালি থানায় ২১টি, ওয়ারীতে ১৬টি, গেণ্ডারিয়ায় ১৪টি, হাজারীবাগে ১৩টি, তুরাগে ১২টি, বাড্ডায় ১০টি, বনানীতে নয়টি, মোহাম্মদপুরে নয়টি, দারুসসালাম ও গাবতলীতে আটটি, ডেমরায় আটটি এবং তেজগাঁও থানায় ছয়টি মণ্ডপসহ বাকি থানাগুলোতে দুর্গাপুজা উদযাপন করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘পূজার আগে প্রস্তুতির জন্য আমরা বেশি সময় পাইনি। তবে আমরা সুশৃঙ্খলভাবে যেন পূজা উদযাপন করতে পারি এজন্য কাজ করে যাচ্ছি।’