পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কোম্পানি ফ্যামিলিটেক্সের উৎপাদন বন্ধ বলে এতদিন যে তথ্য ছিল, তার বিপরীত চিত্র দেখতে পেয়েছে পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদ।
কোম্পানিটির সিংহভাগ পরিচালকের হাতে থাকা শেয়ার ঘোষণা ছাড়া বিক্রি করে চলে গেলেও একজন পরিচালক তার মতো করে উৎপাদন চালু রেখেছেন। এই কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে।
তবে আর্থিক সংকটে পুরোপুরি নয়, সক্ষমতার এক-তৃতীয়াংশ উৎপাদন ক্ষমতা ব্যবহার করছেন তিনি। তিনি কোম্পানিটিকে পুরোদমে উৎপাদনে আনতেও আগ্রহী।
বন্ধ জেনে কোম্পানিটির পর্ষদ ভেঙে দেয়ার পর নতুন যারা দায়িত্ব পেয়েছেন, তারা চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে কারখানা পরিদর্শন করে এই চিত্র দেখতে পেয়ে অবাক হয়েছেন।
এরই মধ্যে নতুন পর্ষদ কোম্পানিটি আগের পরিচালককে রেখেই চালু করার সুপারিশ করে বিএসইসিকে প্রতিবেদন দিয়েছে। কোম্পানিটির যে সম্পদ আছে, তার বিপরীতে সহজেই ঋণ নেয়া যেতে পারে বলে তারা মনে করছে।
মাস কয়েক আগে ব্যাংকের সঙ্গে জটিলতায় কোম্পানিটির শ্রমিকদের বেতন বকেয়া পড়লেও সেই সমস্যারও সমাধান হয়েছে। কোম্পানিটি যিনি চালু রেখেছেন, তিনি আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশেও রাজি হয়েছেন।
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি এই কোম্পানিটিকে অন্য কোনো কোম্পানির সঙ্গে একীভূত করা এমনকি বিক্রি করে দেয়ার বিষয়েও ভাবছিল। তবে নতুন পরিচালনা পর্ষদ সুপারিশ করেছে, আগের মালিককেই কোম্পানিটির দায়িত্বে রাখার। তারা বলছে, পোশাক কারখানা পরিচালনায় তিনি বেশ দক্ষ।
কোম্পানিটি ৯ বছর আগে তালিকাভুক্ত হওয়ার এক বছর পর ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার দেয় চমক দেখালেও পরে হতাশ করে বিনিয়োগকারীদেরকে। টানা লোকসানের পাশাপাশি উদ্যোক্তা-পরিচালকদের ঘোষণা না দিয়ে শেয়ার বিক্রি করে করে দেয়ার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয় বিনিয়োগকারীরা।
এই অভিযোগ ওঠার পর বিএসইসি তদন্ত কমিটি গঠন করে পরিচালকদেরকে জরিমানাও করে, কিন্তু জরিমানা পরিশোধ করা হয়নি। বরং সে সময় জানা গিয়েছিল, মালিকপক্ষ কারখানা বন্ধ করে লাপাত্তা।
বিএসইসি বন্ধ ও লোকসানি ১২টির বেশি কোম্পানিতে প্রাণ ফেরাতে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার মধ্যে একটি এই ফ্যামিলিটেক্স।
গত ফেব্রুয়ারিতে বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়। তারপর অনেকবার আলোচনায় আসে কোম্পানিটি আর চালু করা সম্ভব হবে না। বিএসইসি চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম এমনও বলেন যে, তারা কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। পরে কারখানা বিক্রি করে দেয়ার পরিকল্পনার কথা বলেন।
কিন্তু সেপ্টেম্বরের শুরুতে পুনর্গঠন করা বোর্ডের সদস্যরা পরিদর্শন করেন ফ্যামিলিটেক্সের কারখানা। সেখান থেকে ফিরে তারা জানালেন, কোম্পানির সক্ষমতার প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ উৎপাদনে।
মালিকানায় থাকা মেরাজ মোস্তফা কায়সার কোম্পানিটির তার তত্ত্বাবধানে চালু রাখতে চান বলে জানিয়েছেন নতুন বোর্ড সদস্যদের। কোম্পানি চালু রাখার জন্য প্রয়োজনীয় চলতি মূলধনের ব্যবস্থা করে দিলে তিনি আগের মতোই উৎপাদন শুরু করতে পারবেন বলে জানিয়েছেন।
পুনর্গঠিত পর্ষদের ড. মো. ফরজ আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিএসইসির পক্ষ থেকে আমাদের ৩০ সেপ্টেম্বরে মধ্যে কোম্পানিটি সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছিল। আমরা তা জমা দিয়েছি। সেখানে বিস্তারিত উল্লেখ করেছি।
‘আমরা কোম্পানিটি পরিদর্শন শেষে যা দেখেছি তাই বিএসইসিকে জানিয়েছি। পাশাপাশি কোম্পানিটি চালু রাখতে হলে কী কী কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন করতে হবে সে বিষয়গুলোকেও অবহিত করা হয়েছে।’
ফ্যামিলিটেক্সের পণ্য এখন বাইরেও রপ্তানি হচ্ছে। ছবি: নিউজবাংলাআগের মালিককে দিয়েই কোম্পানিটিকে পুনরুজ্জীবিত করার পক্ষে ড. ফরজ আলী। তিনি বলেন, ‘এখন যিনি কোম্পানিটি পরিচালনা করছেন, তিনি চালালেও কোম্পানির কমপ্লায়েন্স বাস্তবায়ন করতে হবে, অন্য কাউকে দিয়ে চালালেও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। ফলে যিনি বর্তমানে এটি পরিচালনা করছেন তাতে দিয়ে করানোই ভালো। কারণ, তার এ খাতের ভালো অভিজ্ঞতা আছে।’
ফ্যামিলিটেক্সের নতুন পর্ষদের সদস্য ও কারখানা পরিদর্শনে যাওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সমীর কুমার শীল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যেভাবে কোম্পানিট বন্ধ বলা হচ্ছে আসলে তা নয়। কোম্পানি বোর্ড পুনর্গঠন করার আগ থেকেই কোম্পানি এভাবেই চলছে।’
তিনি বলেন, ‘পরিদর্শনে আমরা কোম্পানিটিতে প্রায় তিন থেকে চারশ শ্রমিককে কাজ করতে দেখেছি। বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানিতে তাদের পোশাক রপ্তানি হচ্ছে সেটিও তারা নিশ্চিত করেছে।
‘কোম্পানিটির আগের যারা পরিচালক ছিল তারা তাদের শেয়ার বিক্রি করে চলে গেলেও বর্তমানে যে পরিচালক আছেন তিনি এটি ছেড়ে যাবেন না বলে জানিয়েছেন। তবে তার এখন কোম্পানিটি চালু করতে মূলধন প্রয়োজন।’
ব্যাংকে কোম্পানির ৭০ কোটি টাকার বেশি ঋণ আছে। তবে কোম্পানিটির যে সম্পদ আছে সেটির মূল্য ১২০ কোটি টাকার বেশি। ফলে নতুন করে ঋণ নিয়ে কোম্পানি চালু করা কঠিন হবে না বলেই মনে করছেন এই অধ্যাপক।
তিনি বলেন, ‘নতুন বোর্ড গঠন করার পর কোম্পানিটি তার ব্যাংকের লেনদেন জটিলতা তৈরি হয়েছিল। ফলে কয়েক মাসের বেতনও বকেয়া পড়ে যায়। তবে আমরা পরিদর্শনে যাওয়ার পর এ বিষয়ে সমাধান করে দিয়েছে।
‘নতুন পুনর্গঠিত বোর্ডের চেয়ারম্যান ও কোম্পানির পরিচালকের যৌথ স্বাক্ষরে ব্যাংকের হিসাব পরিচালিত হবে। ফলে এখন আর ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেনের যে জটিলতা ছিল সেটি এখন নেই। এবং তিনি তার কর্মচারীদের বেতনও পরিশোধ করে দিয়েছেন।’
কোম্পানিটি আবার পুরোদমে চালু হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু- এমন প্রশ্নে সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আর্থিক সহযোগিতা প্রয়োজন। কোম্পানিটিকে তার পূর্বের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করার কথা বলা হয়েছে, সেটিও তারা দেবেন বলে জানিয়েছেন।’
এ বিষয়ে বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই। আর তারা প্রতিবেদন দিয়ে থাকলেও সেটি অন্য কোনো বিভাগে দিয়েছে। এ বিষয়ে কমিশন যখন সিদ্ধান্ত নেবে, তখন জানানো হবে।’
ফ্যামিলিটেক্সের আদ্যোপান্ত
২০১৩ সালে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় কোম্পানিটি। ১০ টাকা মূল্যমানের সাড়ে তিন কোটি শেয়ার ছেড়ে তারা সংগ্রহ করে ৩৫ কোটি টাকা।
তালিকাভুক্তির পর ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত অর্থবছরের আর্থিক হিসাব পর্যালোচনা করে কোনো লভ্যাংশ দেয়নি। তবে ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১০০ শতাংশ বোনাস লভ্যাংশ ঘোষণা করে কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদ।
ওই বছর কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় দেখানো হয় ৭ টাকা ২৬ পয়সা আর শেয়ারপ্রতি সম্পদ মূল্য হয় ২১ টাকা ৭২ পয়সা। এই লভ্যাংশ ঘোষণার পরদিন ১ এপ্রিল কোম্পানিটির শেয়ার দর দাঁড়ায় ৬২ টাকা, যদিও একপর্যায়ে দাম ৭৪ টাকা ৮০ পয়সায় দাঁড়িয়েছিল।
বিপুল পরিমাণ বোনাস শেয়ার দেয়ার পর থেকেই ফ্যামিলিটেক্সের আয় কমতে থাকে। ২০১৫ থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত সমাপ্ত অর্থবছরে তারা সবশেষ মুনাফা করেছিল। তখন শেয়ারপ্রতি আয় হয় ৮২ পয়সা। এর পরের চার বছর ধরে লোকসান দিচ্ছে তারা।
২০১৭ সালে শেয়ারপ্রতি লোকসান হয় সাড়ে ৪ পয়সার মতো। পরের বছর লোকসান হয় ৭ পয়সা, ২০১৯ সালে লোকসান হয় ৮ পয়সা। আর ২০২০ সালে লোকসান হয় ১৫ পয়সা।
২০১৩ সালে ১০০ শতাংশ বোনাস শেয়ার লভ্যাংশ হিসেবে দেয়ার পরের বছর তারা দেয় আরও ১০ শতাংশ বোনাস। এর পরের তিন বছর দেয় ৫ শতাংশ করে। কিন্তু গত দুই বছর কোনো লভ্যাংশই দেয়া হয়নি।
অথচ পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগে কোম্পানির আয় ক্রমেই বাড়ছিল। তালিকাভুক্তির আগে তিন বছরের আর্থিক প্রতিবেদন জমা দিতে হয় বিএসইসিতে।
সেখানে দেখা গিয়েছিল ২০১১ ও ২০১২ সালে কোম্পানিটির মুনাফা বেড়েছিল চার গুণের বেশি। আর তালিকাভুক্ত হওয়ার বছরে মুনাফা বাড়ে আরও ৭৬ শতাংশ।
গত বছর কোম্পানিটি শেয়ারপ্রতি ১৫ পয়সা করে লোকসান দেয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই প্রান্তিক অর্থাৎ ছয় মাসে লোকসান দিয়েছে ১৩ পয়সার কিছু বেশি।
এর মধ্যে উদ্যোক্তা পরিচালকরা আরেকটি আইনবিরুদ্ধ কাজ করেন। পুঁজিবাজারে ঘোষণা না দিয়েই উদ্যোক্তা-পরিচালকরা তাদের হাতে থাকা সিংহভাগ শেয়ার বিক্রি করে দেন।
এই বিষয়টি তদন্তে ডিসেম্বরের শেষে একটি কমিটি করে বিএসইসি। তারা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছে কি না, সেটি এখনও জানা যায়নি। আর এ জন্য পরিচালকদের তেমন কোনো শাস্তিও পেতে হয়নি।
কোম্পানিটির ৩৫ কোটি ৪০ লাখ শেয়ারের মধ্যে এখন মাত্র ৪.০২ শতাংশের মালিক কোম্পানির উদ্যোক্তা পরিচালকরা। অথচ বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী অন্তত ৩০ শতাংশ শেয়ার ধরে রাখতে হবে মালিকপক্ষ।
এই কোম্পানির ৭৭.৫৭ শতাংশ শেয়ার সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে। ক্রমাগত লোকসান দিতে থাকা কোম্পানির শেয়ার দরও একেবারে তলানিতে। এক পর্যায়ে দাম ২ টাকা ৪০ পয়সায় নেমে আসে। তবে বোর্ড পুনর্গঠনের পর গত আগস্টে দাম বেড়ে এক পর্যায়ে ৬ টাকা ৮০ পয়সা পর্যন্ত পৌঁছে। তবে গত এক মাস ধরে আবার কমছে। রোববার দাম দাঁড়িয়েছে ৫ টাকা ২০ পয়সা।