করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকার পর সশরীরে ক্লাস শুরু হলেও উপস্থিতির সংখ্যা এখন পর্যন্ত বেশ কম।
প্রাথমিকের পঞ্চম শ্রেণিতে তাও ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। তবে ওপরের মাধ্যমিকে তা ৬০ শতাংশের আশপাশে। আর উচ্চ মাধ্যমিকে ৫০ শতাংশেরও কম।
করোনার সময় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর ঝরে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল। স্কুল-কলেজ খোলার পর কত ছাত্র-ছাত্রী ঝরে গেছে, সেই হিসাব এখনও চূড়ান্ত করা হয়নি। তবে নিউজবাংলা দেশের নানা প্রান্তে স্কুল-কলেজে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীই ক্লাসে আসছে না।
এই চিত্র গ্রাম বা মফস্বলের ক্ষেত্রে যেমন, ঢাকায় যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানরা পড়ে, সেসব স্কুলের ক্ষেত্রেও তেমনি।
যারা স্কুলে আসছে না, তাদের বিষয়ে এখনও খোঁজ নেয়ার কোনো সমন্বিত উদ্যোগ নেই। ফলে তারা ঝরে গেছে, নাকি ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কারণে অনুপস্থিত, সেই সিদ্ধান্তে আসার মতো সময় এখনও আসেনি।
তবে এর একটি বড় অংশ যে আর শিক্ষায় ফিরবে না, সে বিষয়ে শিক্ষকদের মধ্যেই তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
করোনার প্রাদুর্ভাবের আগে ২০১৯ সালে প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ছিল ১৭.৯ শতাংশ আর মাধ্যমিকে এই হার ছিল ৩৭.৬২ শতাংশ।
এই হার ছিল ক্রম হ্রাসমান। তবে করোনার কারণে সেটি আবার বাড়বে বলে আশঙ্কা ছিল আগেই।
রাজধানীর দুই স্কুলে গিয়ে যা দেখা গেল
রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন স্কুলে দশম শ্রেণির ছাত্র মোট ৭১ জন। পঞ্চম শ্রেণিতে ৩৫ জন আর চলতি বছরের এসএসসি পরীক্ষার্থী ৬৩ জন।
নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তানরা পড়াশোনা করে, এমন স্কুলটির প্রধান শিক্ষক দুলাল চন্দ্র চৌধুরী জানান, এই তিন শ্রেণিতে অর্ধেকের মতো ছাত্র আসছে না।
কেন আসছে না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অনেকের বাবা-মা হয়তো আসতে দিচ্ছে না। তারা অনলাইনে পড়ে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। আবার এখন পরীক্ষার জন্য সংক্ষিপ্ত যে পাঠ, সেটিও হয়তো শেষ করে ফেলেছে।’
মগবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সামসুন নাহার বেগম জানালেন, বুধবার পঞ্চম শ্রেণির ক্লাসে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬২ জনের মধ্যে উপস্থিত ছিল ৩২ জন।
এই স্কুলটির শিক্ষার্থীরাও নিম্ন আয়ের পরিবারের সন্তান।
কেন তাদের মধ্যে শিক্ষা নিয়ে আগ্রহ কমে গেল, জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘অনেকের পরিবার গ্রামে চলে গেছে। অনেকে কাজে লেগে যেতে পারে।’
অর্থাৎ এই শিক্ষক নিজেও আশঙ্কা করছেন, একটি বড় অংশ হয়তো ঝরে যাবে প্রাথমিক শেষ না করেই।
উপস্থিতি নিয়ে সরকারি তথ্য যা বলছে
২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ করে দেয়া হয় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রায় দেড় বছর পর গত ১২ সেপ্টেম্বর স্কুল-কলেজে ক্লাস শুরু হয়। তবে প্রতিদিন সব শ্রেণিতে ক্লাস হবে না। চলতি বছরের ও আগামী বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ক্লাস নেয়া হচ্ছে। আর অন্যান্য শ্রেণির মধ্যে অষ্টম, নবম, তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণিতে দুই দিন এবং অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একদিন ক্লাসে আসতে বলা হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখার তৈরি করা উপস্থিতির প্রতিবেদনে গত সাত দিনের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, পঞ্চম শ্রেণিতে উপস্থিতি সর্বনিম্ন ৬৯ থেকে সর্বোচ্চ ৭৬ শতাংশ।
গত ২১ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী দশম শ্রেণিতে উপস্থিতি সর্বনিম্ন ৫৯ শতাংশ আর সর্বোচ্চ ৬৭ শতাংশ।
এই সময়ে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি সর্বনিম্ন ৬০ শতাংশ আর সর্বোচ্চ ৬৪ শতাংশ।
একাদশ শ্রেণিতে উপস্থিতি সর্বনিম্ন ৪৮ আর সর্বোচ্চ ৫২ শতাংশ। দ্বাদশ শ্রেণিতে উপস্থিতি সর্বনিম্ন ৪২ শতাংশ আর সর্বোচ্চ ৪৫ শতাংশ।
হঠাৎ করে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমছে কেন, এমন প্রশ্নে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন শাখা) অধ্যাপক আমির হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষার্থী ও পরিবারের সদস্য অসুস্থ থাকার কারণে কেউ কেউ ক্লাসে আসছে না। অনেকে আবার স্থানান্তর, অভিভাবকের আপত্তিসহ নানা কারণে অনুপস্থিত থাকছে। অনেকেই বাসা ও অনলাইনে বসে পড়াশোনা শেষ করছে।’
করোনার কারণে অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে জানিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন) উত্তম কুমার দাশ বলেন, ‘গ্রামের তুলনায় শহরে উপস্থিতি কিছুটা কম। কারণ অনেকেই ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা কোনো শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত না হলে কেন সে উপস্থিত হলো না, তা খুঁজে বের করার জন্য শিক্ষকদের নির্দেশ দিয়েছি।’
কারণ অনুসন্ধান করে বিশেষ উদ্যোগ চান শিক্ষাবিদ
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামকে স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির হার জানালে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তার মতে, বিভিন্ন কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি কমতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে পিতা-মাতার আর্থিক অসচ্ছলতা, দীর্ঘদিন পড়াশোনার বাইরে থাকা।
করোনার কারণে গ্রামে বাল্যবিবাহ মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে বলেও মনে করেন এই শিক্ষাবিদ। বলেন, ‘আমরা আশঙ্কা করছি, বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়বে।’
এই অবস্থায় কী করা উচিত- এমন প্রশ্নে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারের কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা নেয়া উচিত। স্কুলে আসতে স্থানীয়ভাবে উৎসাহ দিতে হবে এবং আর্থিক সহায়তা দেয়ার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।’
শিক্ষামন্ত্রী যা বলেছেন
স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি গত ২৩ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নিয়ে চাপ দেয়া যাবে না। দেখতে হবে সে কেন উপস্থিত হলো না। কোনোভাবেই জোর করা যাবে না। কারণ কোনো শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে পাঠ গ্রহণ না করতে পারলেও তার জন্য অনলাইন ও টিভিতে এখনো ক্লাস চালু আছে।’
মন্ত্রী বলেন, ‘করোনা এমন একটি বিষয় যেকোনো জায়গায় যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিংটা রাখছি।’
চার দিন পর মন্ত্রী আবার বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে পড়ার কারণে কোনো কোনো অভিভাবক হয়তো শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠাচ্ছেন না।’
সাত দিনের উপস্থিতির চিত্র
২৮ সেপ্টেম্বর সারা দেশের ১৫ হাজার ৯০২টি স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উপস্থিতি ছিল ৫৫ শতাংশ।
এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির ১ লাখ ১২ হাজার ৭৮৫ জনের মধ্যে ৭৮ হাজার ৮০৯ জন উপস্থিত ছিল। উপস্থিতির হার ৭০ শতাংশ।
দশম শ্রেণির ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৫৮০ জনের মধ্যে ৭ লাখ ৯২ হাজার ৭৪৪ জন উপস্থিত ছিল। উপস্থিতির হার ৬১ শতাংশ।
২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ, একাদশে ৪৮ শতাংশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
২৭ সেপ্টেম্বর সারা দেশের ১৬ হাজার ৪৪৯ স্কুল-কলেজে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির ১ লাখ ১৭ হাজার ১২৯ জনের মধ্যে ৮৬ হাজার ৭৪৮ জন। উপস্থিতির হার ৭৪ শতাংশ।
দশম শ্রেণির ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৩৬৫ জনের মধ্যে ৮ লাখ ৪৪ হাজার ৩৫১ জন উপস্থিত ছিল। উপস্থিতির হার ৬২ শতাংশ।
২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬১ শতাংশ, একাদশে ৫১ শতাংশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
২৬ সেপ্টেম্বর সারা দেশের ১৬ হাজার ৮০০ স্কুল-কলেজে ৫৮ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির ১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫১ জনের মধ্যে ৮৮ হাজার ৮৮১ জন ক্লাসে আসে। উপস্থিতির হার ৭৫ শতাংশ।
দশম শ্রেণির ১৩ লাখ ৭৩ হাজার ২৮৪ জনের মধ্যে ৮ লাখ ৭২ হাজার ৩৩২ জন উপস্থিত ছিল। উপস্থিতির হার ৬৪ শতাংশ।
২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬২ শতাংশ, একাদশে ৫২ শতাংশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
২৫ সেপ্টেম্বর সারা দেশের ১৫ হাজার ৮৬০ স্কুল-কলেজে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির ৯২ হাজার ৮৯৪ জনের মধ্যে ৬৪ হাজার ১১০ জন ক্লাসে আসে। উপস্থিতির হার ৬৯ শতাংশ।
দশম শ্রেণির ১৩ লাখ ৪৯ হাজার ৭১৯ জনের মধ্যে ৮ লাখ ১৮ হাজার ৯৬৮ জন উপস্থিত ছিল। উপস্থিতির হার ৬১ শতাংশ।
২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬২ শতাংশ, একাদশে ৫০ শতাংশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ৪২ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
২৩ সেপ্টেম্বর সারা দেশের ১৬ হাজার ৮৮১ স্কুল-কলেজে ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির ১ লাখ ২১ হাজার ৮৯৭ জনের মধ্যে ৯০ হাজার ৯৬৩ জন উপস্থিত ছিল। উপস্থিতির হার ৭৫ শতাংশ।
দশম শ্রেণির ১৩ লাখ ৭৮ হাজার ৯২০ জনের মধ্যে ৮ লাখ ৫৮ হাজার ১২৯ জন উপস্থিত ছিল। উপস্থিতির হার ৬২ শতাংশ।
২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬১ শতাংশ, একাদশে ৫১ শতাংশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ৪৩ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
২২ সেপ্টেম্বর সারা দেশের ১৭ হাজার ১৬৫ স্কুল-কলেজে ৫৭ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির ১ লাখ ২৬ হাজার ৯২৮ জনের মধ্যে ৯৬ হাজার ৮৯৫ জন ক্লাসে আসে। উপস্থিতির হার ৭৬ শতাংশ।
দশম শ্রেণির ১৫ লাখ ৮ হাজার ৬৩২ জনের মধ্যে ৮ লাখ ৯১ হাজার ৪৫ জন উপস্থিত ছিল। উপস্থিতির হার ৫৯ শতাংশ।
২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ, একাদশে ৫১ শতাংশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ৪৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
২১ সেপ্টেম্বর সারা দেশের ১৭ হাজার ৬৪০ স্কুল-কলেজে ৫৯ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।
এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির ১ লাখ ৩১ হাজার ১২৭ জনের মধ্যে ৯৭ হাজার ২৯২ জন ক্লাসে আসে। উপস্থিতির হার ৭৪ শতাংশ।
দশম শ্রেণির ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৬৫৩ জনের মধ্যে ৯ লাখ ৫০ হাজার ৪৪৭ জন উপস্থিত ছিল। উপস্থিতির হার ৬৭ শতাংশ।
২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৩ শতাংশ, একাদশে ৫১ শতাংশ এবং দ্বাদশ শ্রেণিতে ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল।