বঙ্গোপসাগরের গর্জন। পাশেই বনের শ্যামলিমায় পৃথিবীখ্যাত মায়াবী চিত্রা হরিণের দুরন্তপনা। আছে নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনচিত্রে ভরপুর রাখাইন পল্লী। আরও আছে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযুদ্ধ।
এসব বাহারি সৌন্দর্যের সমাহার ঘটেছে বরগুনা জেলায়। বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এই জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে ঘিরে দেশের পর্যটন শিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। জেলাটি হয়ে উঠতে পারে দেশের অন্যতম ইকোট্যুরিজম জোন।
উদ্যোক্তারা বলছেন, ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলকে তুলে ধরতে এবং আকর্ষণীয় করতে প্রয়োজন কার্যকরী উদ্যোগ।
বর্ষাকাল শেষ। শরতে বনভূমি এখন শ্যামল-সবুজ। এখানকার সৌন্দর্য যে কাউকে বিমোহিত করে। পাশাপাশি এখানে রয়েছে বিশাল বালিয়াড়ি, যেখানে সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখার সুযোগ মিলবে। অভয়াশ্রমে দেখা মিলবে হরিণসহ বন্য প্রাণী ও পাখির।
রয়েছে বনের ভেতরে অসংখ্য সরু খালে নৌকার ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ। প্রকৃতির শ্যামল-ছায়ার কোমল পরশ যেমন মিলবে, তেমনি দেখা যাবে পৃথিবীখ্যাত মায়াবী চিত্রল হরিণের দুরন্তপনা, রাখাইন নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনচিত্র, চরাঞ্চলের মানুষের জীবনযুদ্ধ।
বরগুনার ও নিকটবর্তী স্পটগুলো- চর বিজয়, বঙ্গবন্ধু দ্বীপ, আশারচর, সোনাকাটা, টেংরাগিরি, শুভসন্ধ্যা সৈকত, সংরক্ষিত বনাঞ্চল, লালদিয়ারচর, হরিণঘাটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল, পদ্মার চর, সোনাতলা, মোহনা, চুলুর চর, ঐতিহাসিক বিবিচিনি শাহী মসজিদ, গাজীকালু ও চম্পাবতীর মাজার, জাহাজভাঙ্গা শিল্পাঞ্চল, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ প্রায় দুই ডজন পর্যটন স্পট এখন খুলে দিচ্ছে দেশের পর্যটন শিল্পের অমিয় সম্ভাবনারদ্বার।
বরগুনায় বঙ্গোপসাগর তীরের কয়েকটি প্রাকৃতিক দর্শনীয় স্থান পর্যটনের নতুন দুয়ার খুলে দিতে পারে। এর মধ্যে তালতলীর টেংরাগিরি বনাঞ্চল ও ইকোপার্ক, শুভসন্ধ্যা সৈকত, পাথরঘাটার হরিণঘাটা ইকোপার্ক ও সুজিত বন উল্লেখযোগ্য। তবে সুযোগ-সুবিধা ও প্রচারের অভাবে প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্যময় পর্যটনকেন্দ্রগুলো বিকশিত হচ্ছে না।
টেংরাগিরি বনাঞ্চল
এই বন থেকে শোনা যায় সাগরের গর্জন। সাগর থেকে উঠে আসা বাতাসে ছন্দময় অনুরণন তোলে গাছের পাতা।
বরগুনার তালতলী উপজেলার ফকিরহাটে অবস্থিত টেংরাগিরি একসময় সুন্দরবনের অংশ ছিল। প্রাকৃতিক এই বনকে স্থানীয় লোকজন ‘ফাতরা বন’ হিসেবে চেনে। সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল হিসেবে টেংরাগিরি স্বীকৃতি পায় ১৯৬৭ সালে।
তালতলী থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পর্যন্ত বিস্তৃত এই বনের আয়তন ১৩ হাজার ৬৪৪ একর। ২০১০ সালের ২৪ অক্টোবর ৪ হাজার ৪৮ দশমিক ৫৮ হেক্টর জমি নিয়ে গঠিত হয় টেংরাগিরি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য।
এই বনাঞ্চলের তিন দিকে বঙ্গোপসাগর, বান্দ্রা খাল, সিলভারতলীর খাল, ফেচুয়ার খাল, গৌয়মতলার খাল, কেন্দুয়ার খাল, সুদিরের খাল, বগীরদোন খাল। বনাঞ্চলের সখিনা বিটে ২০১১ সালে ইকোপার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয়। টেংরাগিরি বনাঞ্চলের অভয়ারণ্যে ১০টি হরিণ, ২৫টি শূকর, ৩টি চিতা বাঘ, ২৫টি অজগর, ২টি কুমির, শতাধিক বানর, দুইটি শজারুসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্য প্রাণী রয়েছে।
তালতলীর ২৩টি পল্লিতে বসবাস রাখাইন সম্প্রদায়ের। তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন, প্রাচীন উপাসনালয়, বুদ্ধমূর্তিগুলো পর্যটকদের ভিন্ন মাত্রার আনন্দ দেয়। বনের ভেতরে ছোট ছোট অসংখ্য খাল রয়েছে।
হরিণঘাটা বনাঞ্চল
মায়াবী হরিণের দলবেঁধে ছুটে চলা, চঞ্চল বানর আর বুনো শূকরের অবাধ বিচরণ, পাখির কলরবে সারাক্ষণ মুখর থাকে হরিণঘাটা বনাঞ্চল। পাথরঘাটার বঙ্গোপসাগরের মোহনায় পায়রা-বিষখালী-বলেশ্বর এই তিন নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত হরিণঘাটা।
এই বনে হরিণ, বানর, শূকর, কাঠবিড়ালি, মেছো বাঘ, ডোরা বাঘ, সজারু, শৃগালসহ অসংখ্য বুনো প্রাণীর বিচরণ।
দৃষ্টিনন্দন ঘন বন আর সবুজে ছাওয়া হরিণঘাটা বনের সৌন্দর্যকে আরও আকর্ষণীয় করেছে সুবিশাল তিন সৈকত- লালদিয়া, পদ্মা ও লাঠিমারা। চর লাঠিমারা থেকে শুরু করে মুতাইন্যা পর্যন্ত ৫ হাজার ৬০০ একর আয়তন নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বনাঞ্চল।
‘লালদিয়া সংরক্ষিত বনাঞ্চলে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও ইকো ট্যুরিজম সুযোগ বৃদ্ধি প্রকল্পের’ আওতায় ৯৫০ মিটার ফুটট্রেইল (হাঁটার কাঠের সেতু) স্থাপন করা হয়েছে। রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার, বেঞ্চ, ঘাটলা ও ইটের রাস্তা। মিঠাপানির জন্য খনন করা হয়েছে পুকুর। বনের ভেতরে অসংখ্য খাল রয়েছে। এসব খালের ভেতরে ঘুরে দেখতে ভাড়ায় নৌকা পাওয়া যায়।
এভারগ্রীন টুলুর চর
বরগুনা শহর থেকে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে বরইতলা ফেরিঘাটের মাঝামাঝি বিষখালী নদীতে টুলুর চর আরেক সৌন্দর্যের হাতছানি। বিষখালী নদীর মাঝে এই বন এখন ঘন, গাঢ় সবুজে আচ্ছাদিত।
নদীর বুকে জেগে ওঠা এই চর মেতে থাকে হরেক পাখির কিচিরমিচির শব্দ। প্রয়াত সাংসদ গোলাম সবুর টুলুর নামে এর নামকরণ করা হয়েছে। সেখানকার সৈকতের নাম শুভসন্ধ্যা। দীর্ঘ সৈকতে হাওয়ায় দোল খায় ঝাউ বন।
এখনও খুব একটা পরিচিত নয় তালতলীর টেংরাগিরি বনের ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে গড়ে ওঠা এই পর্যটনকেন্দ্র। এ কারণে এখানে মানুষের আনাগোনা কম। তবে বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ বেলাভূমির সঙ্গে বনভূমির নৈসর্গিক শোভা দেখতে এখন দূর-দূরান্ত থেকেও মানুষ ছুটে যাচ্ছেন নতুন এই সৈকতে।
মোহনা পর্যটন কেন্দ্র
বরগুনা জেলা শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সদর উপজেলার এম বালিয়াতলী ইউনিয়নের পায়রা-বিষখালী নদীর মোহনার প্রায় এক কিলোমিটার এলাকার মোহনা পর্যটন কেন্দ্র। ‘সবুজ বরগুনা’ নামের একটি সংগঠনের কর্মীদের স্বেচ্ছাশ্রমে নান্দনিক হয়ে ওঠা এই জায়গা এখন দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
নদী ভাঙনের হাত থেকে এই জায়গাকে নিরাপদে রাখতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিছানো ব্লক ঢেকে দেয়া হয়েছে নানান রঙ দিয়ে। শুধু তাই নয়, দুর্গম এই এলাকার মানুষ যেন ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পায় সেজন্য লাগানো হয়েছে ৩০টির মতো বটগাছ।
পর্যটনশিল্প বিকাশের উদ্যোগ
দক্ষিণের পর্যটন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন আরিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বরগুনা জেলায় বেশ কিছু প্রাকৃতিক নৈসর্গিক স্পট রয়েছে যা দেশের কোথাও আর নেই। ইকোট্যুরিজমের জন্য ওই স্থানগুলো বাংলাদেশের যে কোনো এলাকার চেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও উপভোগ্য।
‘তবে আমাদের এসব এলাকার প্রচার নেই, নেই বিকাশে কার্যকরি কোনো সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ। বিশেষ করে পর্যটকদের যাতায়তের জন্য সড়ক, থাকা খাওয়া ও নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই। উন্নয়ন হলে বরগুনা দেশের অন্যতম পর্যটন ক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে।’
দক্ষিণের সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্পের বিকাশের জন্য পটুয়াখালী ও বরগুনা ঘিরে বিশেষ পর্যটন এলাকা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা পর্যটন উদ্যোক্তা কমিটির সভাপতি সোহেল হাফিজ।
তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে জেলার বেশ কিছু স্পট চিহ্নিত করে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।
‘যত দূর জানি, সরকারের একটি প্রকল্পের আওতায় পটুয়াখালীর কলাপাড়া, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী এবং বরগুনা সদর, আমতলী, তালতলী ও পাথরঘাটা উপজেলাকে ঘিরে বিশেষ এই পর্যটনশিল্প গড়ে তোলা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পায়রা বন্দরনগরী ও কুয়াকাটা উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ-পর্যটনভিত্তিক সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন নামের প্রকল্পটি ২০১৭ সালে পরিকল্পনা কমিশন এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। চার বছরেও আমরা সেই প্রকল্পের অগ্রগতি লক্ষ্য করছি না। আমাদের দাবি, বরগুনার পর্যটন স্পটগুলোর বিকাশে সরকার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করুক।’