করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দীর্ঘ ১৮ মাস বন্ধ থাকার পর ১২ সেপ্টেম্বর থেকে খুলেছে দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মুখরিত হতে শুরু করেছে স্কুলগুলো। তবে জেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেন মিলিয়ে অন্তত ৪২ হাজার শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার তথ্য দিয়েছে জেলা শিক্ষা অফিস।
নোয়াখালী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, জেলার ৯ উপজেলায় ১ হাজার ২৫৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪ লাখ ৮০ হাজার ৯০৪ শিক্ষার্থী রয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ৬২ থেকে ৭৩ শতাংশের ওপর ওঠেনি।
জেলা শিক্ষা অফিস ২০২০ সালের ১৬ মার্চের আগেও এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার পর্যালোচনা করেছে। তখন বিদ্যালয়গুলোতে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিতি পাওয়া গেছে। দীর্ঘ ১৮ মাস শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার ৮৫ শতাংশ থেকে কমে গড়ে ৭০ শতাংশে নেমে এসেছে। সে ক্ষেত্রে অনুপস্থিত আছে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী।
জেলা শিক্ষা অফিস জানায়, ২০২১ সালের জরিপে জেলায় ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার তথ্য পাওয়া গেছে। যার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৪৫ জন।
২০১৮ সালেও এপিএসসির জরিপে দেখা গেছে, সারা দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে।
নোয়াখালীতেও সে হার ছিল বেশি, যা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তা ও শিক্ষকদের প্রচেষ্টায় কমে ৫ শতাংশে নিয়ে আসতে পেরেছেন।
সরকারি হিসাবে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ৫ শতাংশ হলেও ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুপস্থিতিতে প্রকৃত ঝরে পড়ার হার আরও বেশি হবে বলে শিক্ষাবিদরা মনে করছেন।
জেলা সদরের চর উরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, ১২ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩০৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিতির হার গড়ে ৬৯ শতাংশ। সবশেষ গত বৃহস্পতিবার পঞ্চম শ্রেণির ৬৫ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিল ৪১ জন। এতে উপস্থিতির হার ৬৩ শতাংশ।
চর উরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সালমা ইমাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কম হচ্ছে। তাদের বিদ্যালয়মুখী করতে আমরা সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করছি।’
এ সময়ে অবশ্য কিন্ডারগার্টেন থেকে ৮ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সদর উপজেলার পূর্ব চর উরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার ৬০ শতাংশ। ২৮২ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫ দিনে গড়ে উপস্থিত ছিল ২০৭ জন। ওই বিদ্যালয়েও বেসরকারি কিন্ডারগার্টেন থেকে ৬ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে।
সদর উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসার নাজিহা বিনতে আনোয়ার বলেন, ‘আমরা নিয়মিত বিদ্যালয় মনিটর করছি। যে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত রয়েছে, তাদের সঙ্গে শিক্ষকরা যোগাযোগ করছেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বুঝিয়ে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আনার চেষ্টা করছেন। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ধরে রাখতে তাদের চকলেট, বেলুন, ফুল ও বিভিন্ন খেলনাসামগ্রী উপহার দিয়ে শিক্ষার্থীদের উৎফুল্ল রাখা হচ্ছে।’
গত বৃহস্পতিবার হাতিয়া উপজেলায় ২২৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৭ হাজার ৮০৩ শিক্ষার্থীর মধ্যে উপস্থিত ছিল ৪ হাজার ৮৪১ জন। ওই উপজেলায় উপস্থিতির হার ৬০ শতাংশ।
হাতিয়া উপজেলা শিক্ষা অফিসার আবদুল হান্নান পাটোয়ারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আনতে হোম ভিজিট ও মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছি। আশা করছি, আগের মতো শিক্ষার্থীদের পদচারণে মুখরিত হবে বিদ্যালয়।’
চাটখিল উপজেলা শিক্ষা অফিসার এ টি এম এহসানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘উপজেলার ১১৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গত ৫ দিনে শিক্ষার্থী উপস্থিতির হার ছিল গড়ে ৬০ শতাংশ। শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিদ্যালয়ে উপস্থিত করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে আসছি।’
সরকারি জরিপে জেলায় ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার রেকর্ড করলে সরেজমিনে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত গড়ে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৭ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। যার সংখ্যা ৩৩ হাজারের বেশি।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন নোয়াখালী উত্তর এবং দক্ষিণ শাখা জানায়, জেলায় ৫৪৩টি কিন্ডারগার্টেনের প্রতিটিতে গড়ে ১২০ জন করে ৬৫ হাজার ১৬০ শিক্ষার্থী ছিল। এর মধ্যে করোনার প্রভাবে বন্ধ হয়ে গেছে ৫৪টি কিন্ডারগার্টেন। করোনায় আর্থিক সংকট এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী বিভিন্নভাবে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়েছে।
কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসায় ভর্তি হলেও জেলায় চলমান ৪৮৯ কিন্ডারগার্টেন থেকে প্রায় ১২ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে, যার সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৪১ জন।
এ ছাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া ৫৪টি কিন্ডারগার্টেনে গড়ে ৬ হাজার ৪৮০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হলেও এখনো ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ ঝরে পড়ার তালিকায় রয়েছে। যার সংখ্যা দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৪৪ জন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন নোয়াখালী দক্ষিণ শাখার সভাপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘করোনা মহামারিতে শিক্ষকদের বেতন দিতে না পারা, বাড়িভাড়া মেটাতে না পারা, অর্থ সংকটে শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে দেয়াসহ বেশ কিছু কারণে সদর উপজেলায় ১১৯টি কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে ১১টি বন্ধের খবর পেয়েছি।’
অনেকেই শিশুশ্রমে যুক্ত হয়েছে বলে জানান তিনি।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন নোয়াখালী উত্তর শাখার সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক জানান, বেগমগঞ্জ উপজেলায় ১১৭টি কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে ১২টি বন্ধ হয়ে গেছে। সোনাইমুড়ির ৫টি, কোম্পানীগঞ্জের একটি এবং সেনবাগে ১০টি কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে যায়।
উত্তর শাখার সহসভাপতি খায়রুল বাশার কবিরহাট উপজেলায় ৬টি কিন্ডারগার্টেন বন্ধের তথ্য জানান।
চাটখিল উপজেলা কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের কোষাধ্যক্ষ মো. সোহেল জানান, উপজেলার ৬৮ কিন্ডারগার্টেনের মধ্যে ১০টি বন্ধ হয়েছে করোনায়।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন নোয়াখালী দক্ষিণ শাখার সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহাম্মদ বলেন, ‘জেলায় ৫৪টি কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিগুলো খোলা থাকলেও উপস্থিতির হার ৫০ শতাংশের নিচে। অনুপস্থিতির ১২ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। ৩৮ শতাংশের মধ্যে কিছু অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছে।’
সদর উপজেলা শিক্ষা অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) সাহাব উদ্দিন বলেন, ‘সদরে ১৯৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১২-১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গড়ে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। বাকিদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্কুলে ফেরাতে কাজ করছেন শিক্ষকরা।’
শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ঝরে পড়ার জরিপ করব ডিসেম্বরের শেষে। এখনও অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া হিসাবে ধরতে পারছি না।’
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘ ১৮ মাস পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে পাঁচ দিনে শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে গড়ে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত রয়েছে। করোনার আগে ২০২০ সালের ১৬ মার্চ বিদ্যালয়ে ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল, যার এখন অন্তত ১৫ শতাংশ কম।’
তার প্রত্যাশা, এই উপস্থিতি কয়েক দিনের মধ্যেই বাড়বে।
শিক্ষার্থী উপস্থিতির হারের হিসাবকে ঝরে পড়া বলা যায় কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পূর্ণাঙ্গ খুলে দিলে ৮০ শতাংশ উপস্থিতি হবে বলে আশা করছি। বাকি ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থীকে ঝরে পড়া বলা যাবে না। তাদের মধ্যে অনেকেই নিয়মিত না হোক, অনিয়মিত হলেও বিদ্যালয়ে আসে। আমাদের চলতি বছরের জরিপে ঝরে পড়ার হার ৫ শতাংশ রেকর্ড হয়েছে।’