কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার বিস্তীর্ণ হাওরের মাঝ দিয়ে গেছে অলওয়েদার সড়ক। জলরাশির মাঝে দৃষ্টিনন্দন সড়কটিতে প্রতিদিনই যান দেশের বিভিন্ন প্রান্তের হাজারো পর্যটক।
ঘুরতে এসে এসব পর্যটকের অধিকাংশই নষ্ট করছেন হাওরের জীববৈচিত্র্যকে। তাদের ফেলা প্লাস্টিকের খাবারের প্যাকেট, বোতল ও পলিথিনে এখন সয়লাব এ অঞ্চল।
পর্যটকদের অসতর্কতায় ভয়ংকর পরিণতির দিকে যাচ্ছে প্রাণ, প্রকৃতি ও হাওরের পরিবেশ। নষ্ট হচ্ছে হাওরের ফসলি জমি, মাছের আবাসস্থল, জলজ উদ্ভিদ ও কীটপ্রতঙ্গ। মানুষও পড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে।
স্থানীয়রা জানান, প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষক। অলওয়েদার সড়কের দুই পাশে বর্ষাকালে যেখানে দেখা যায় বিস্তীর্ণ জলরাশি, শীত ও গ্রীষ্মে সেখানেই মেলে সবুজের সমারোহ। সড়কটি থেকে যতদূর চোখ যায় তা মূলত বোরো ধানের ফসলি জমি। বর্ষাকালে এখানে যে প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে তা গিয়ে জমা হচ্ছে এসব জমিতে।
তারা আরও জানান, হাওরে পর্যাপ্ত ভালো মানের খাবারের হোটেল বা রেস্টুরেন্ট না থাকায় অনেকেই ওয়ান টাইম প্যাকেটে করে খাবার নিয়ে যান শহর থেকে। দুপুরে খাওয়া শেষে প্লাস্টিকের প্লেট, বিরিয়ানির খালি বক্স, প্লাস্টিকের বোতল ও পলিথিন ফেলে যাচ্ছেন হাওরে।
এগুলো জমে সড়কের আশপাশে তৈরি হচ্ছে ময়লার ভাগাড়। সড়কের আশপাশের কৃষিজমিতে জমা হওয়া এসব প্লাস্টিক বা অপচনশীল বর্জ্য উৎপাদন কমাবে ফসল।
কিশোরগঞ্জে সবচেয়ে বেশি পর্যটকের আনাগোনা থাকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের বাড়ি, মিঠামইন জিরো পয়েন্ট এবং অষ্টগ্রামের ভাতশালা সেতুতে।
রাষ্ট্রপতির বাড়ি মিঠামইনের কামালপুরের নৌকাঘাট, মিঠামইন জিরো পয়েন্ট, অষ্টগ্রামের ভাতশালা সেতু এবং ইটনার ছিলনী সেতুর আশপাশে গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তূপ। পানিতে ভাসছে পলিথিন।
ভাতশালা সেতুর পাশে ফসলি জমি রয়েছে কাস্তুল এলাকার কৃষক সাইফুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থাইক্যে রোজই হাজার হাজার মানুষ এহানো বেড়াইতো আইয়ে। এরা দুহরের (দুপুরের) খাওন খায় বিরিজের (ব্রিজের) নিচে বইয়া।
‘খাইয়া খাওনের পেলাস্টিকের (প্লাস্টিকের) পেলেইট, বিরানির খালি ফেকেট, বোতল আর পলিথিন যেইবা ক্ষেতো ফালাইতাছে এরা তো আমরার ক্ষেতের বারোটা বাজাইয়া দিতাছে। পানি কমলে এইতা বেকতা (সব) তো ক্ষেতো জমা অইবো।’
পর্যটকদের অসচেতনতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘হেরা তো একদিন আইয়া আনন্দ কইরে যাইবো গা। আমরার ক্ষেতের তো সর্বনাশ।
‘এহানো যেরা বেড়াইতো আইয়ে এরা দেখছি বেশির ভাগ মানুষই শিক্ষিত, কিন্তু শিক্ষিত মাইনসেও যদি আমরার কৃষকের ক্ষতিডে না বুঝে তাইলে আর কারে কিতা কইমু?’
মিঠামইনের ঢাকী এলাকার কৃষক শাহাবউদ্দীন বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গা থাইক্যে রোজই হাজার মানুষ আমরার এলাকাত বেড়াইতো আইয়ে। এরা খাওনের পেকেট, আর ঠান্ডার খালি বোতল ইড্ডে (ঢিল) মাইরে ক্ষেতো ফালাইয়া দেয়।
‘দোহানের ভিতরে ঝুড়ি থাহার পরেও বোতলডা এরা ফানিতই ফালায়। কিস্তা কইলে আরেকবার গোশা (রাগ) অইবো। এরা মেমান (মেহমান) মানুষ, এক দিনের লাইগ্যে আইছে, ঘুইরে আরেকবার যাইবোগা এই চিন্তা কইরে কিস্তা কই না।’
মিঠামইন জিরো পয়েন্টে একটি ক্যাফের মালিক সৈয়দ হাসিবুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘খালি বোতল, আইসক্রিমের প্যাকেট ফেলার জন্য আমার দোকানে একাধিক ঝুড়িও রয়েছে। তারপরেও পর্যটকেরা সেগুলো ঝুড়িতে না ফেলে সরাসরি পানিতে ফেলে দেন।
‘বারবার তাদের সচেতন করার পরও তারা এমনটা করেন, কিন্তু তাদের খানিকটা অসচেতনতার কারণে যে আমাদের এলাকার ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে সেটা তারা বুঝতেছে না।’
কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য রাষ্ট্রপতিপুত্র রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক জানান, আগে হাওরে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না থাকায় কেউ আসতে চাইতেন না। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নে হাওর এখন সবার পছন্দের জায়গায় পরিণত হয়েছে।
কিছু পর্যটকের অসচেতনতা নিয়ে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘পর্যটকদের একটি বিষয় আমার কাছে খুব খারাপ লেগেছে। তারা যেখানে-সেখানে প্লাস্টিকের ওয়ান টাইম প্লেট, বিরিয়ানির খালি প্যাকেট, প্লাস্টিকের বক্স, প্লাস্টিকের পানীয় বোতলসহ বিভিন্ন ময়লা ফেলে দিচ্ছেন। যেটা বোরো ধানের জমির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর।’
হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসে হাওরের প্রকৃত সৌন্দর্য ধ্বংস না করতে পর্যটকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বলেন, ‘এ ব্যাপারে সচেতন না হলে এই সুন্দর হাওর হবে ময়লার ভাগাড়। হাওরের সৌন্দর্য টিকিয়ে রাখতে পর্যটকসহ হাওরবাসীর সহযোগিতা প্রয়োজন।’