ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের নাটাই উত্তর ইউনিয়নের রাজঘর গ্রামে সাদেক মিয়ার বাড়িতে কান্নায় ভারি হয়ে উঠেছে পরিবেশ। সকালে ট্রেনের ধাক্কায় দুই ছেলেসহ সাদেক নিহত হওয়ার ঘটনায় পুরো এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া। তিনজনকে হারিয়ে নিঃস্ব পুরো পরিবার। এই পরিবারের শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।
আশুগঞ্জে রেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় অটোরিকশায় থাকা দুই ভাইয়ের মৃত্যুর পর তাদের বাবাও মারা গেছেন।
উপজেলার তালশহর এলাকায় রোববার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
ঘটনাস্থলেই মারা যান দুই ভাই রুবেল মিয়া ও পাবেল মিয়া। আহত অবস্থায় তাদের বাবা সাদেক মিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বেলা ১১টার দিকে মারা যান তিনিও। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন অটোরিকশাচালক।
সাদেক ও তার ছেলেরা থাকতেন সদর উপজেলার নাটাই উত্তর ইউনিয়নের রাজঘর গ্রামে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন ফাঁড়ির উপপরিদর্শক (এসআই) সালাউদ্দিন খান নোমান জানান, ভোরে একটি অটোরিকশা জেলা শহর থেকে আশুগঞ্জের দিকে যাচ্ছিল। তালশহর রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা ঢাকা-চট্টগ্রাম মেইল ট্রেন অটোরিকশাটিকে ধাক্কা দেয়। এ সময় অটোরিকশার যাত্রী রুবেল ও পাবেল ঘটনাস্থলেই মারা যান।
বাবা ও দুই ছেলের মৃত্যুতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের রাজঘর গ্রামে শোকের ছায়া। ছবি: নিউজবাংলা
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১১টার দিকে মারা যান সাদেক মিয়া। আহত অটোরিকশাচালকের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন জরুরি বিভাগের চিকিৎসক।
তিনি আরও জানান, দুই ছেলেকে নিয়ে সাদেক গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন। তাদের মরদেহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেনারেল হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে।
সদরের নাটাই উত্তর ইউনিয়নের রাজঘর গ্রামে ৮০ বছর বয়সী সাদেক মিয়ার পরিবারে ছিলেন স্ত্রী, চার ছেলে ও চার মেয়ে। তাদের মধ্যে নিহত রুবেল ও পাবেল জুতার কারখানায় কাজ করতেন। অন্য দুই ছেলে হলেন সোহেল মিয়া ও জুয়েল মিয়া।
সোহেল মিয়া নিউজবাংলাকে জানান, রুবেল ও পাবেল তাদের বাবা সাদেক মিয়াকে নিয়ে বাড়ি থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন। আশুগঞ্জ রেল স্টেশন থেকে ভোর পৌনে ৫টায় তিতাস ট্রেনে ঢাকা যাওয়ার কথা। বাড়ি থেকে ভোর ৪টায় রেলওয়ের উদ্দেশে রওনা দেন তিনজন। তালশহর রেলগেটে ঢাকা মেইল সিএনজি অটোরিকশাটিকে ধাক্কা দেয়।
সুহেলের অভিযোগ, রেলক্রসিংয়ে গেটম্যানের অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটে। গেটম্যান ঘুমিয়ে ছিলেন।কী হবে রুবেলের দুই সন্তানের
৩৫ বছর বয়সী রুবেল পরিবারের চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। সাদেক মিয়ার সঙ্গে সংসারের হাল ধরেন রুবেল। ২৩ বছরের পাবেল সম্প্রতি বিদেশে যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট করেছিলেন।৬ বছর আগে রুবেল বিয়ে করেন হাকিমাকে। এহসান ও মরিয়ম নামের তাদের দুই সন্তান। স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা হাকিমা। বারে বারে বলছিলেন, ‘আমার বাইচ্চাডির কী হইব।’
রুবেলের আত্মীয় ইউসুফ বলেন, ‘এক দুর্ঘটনায় পরিবারটিকে নিঃস্ব করে দিল। বিশেষ করে রুবেলের দুই শিশুর কী হবে।’
বাবা হারানোর বিষয় বুঝতে পারছে না এহসান ও মরিয়ম। বাড়ির চারদিকে ঘুরছে, সবার কান্নাকাটি দেখছে। মুখ ফুটে কিছু বলছে না।
কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারান মোমেনা
স্বামী ও দুই ছেলে হারানোর শোকে কাতর মোমেনা বেগম। কাঁদতে কাঁদতে তিনি যেন বাকরুদ্ধ। কিছুক্ষণ পর পর জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি।
কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সাদেক মিয়া বড় মেয়ে ইয়াছমিন। তাদের এই মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজনরা। মাটিতে লুটিয়ে গড়াগড়ি করছিলেন সবাই।রুবেলের চাচাতো ভাই রোমান মিয়া বলেন, ‘আমার ভাই তো মারাই গিয়েছে, তাকে তো আর ফিরে পাব না। ভাইদের মৃত্যুর জন্য দায়ী গেটম্যান। এখন সরকারের কাছে অনুরোধ দ্রুত এই গেটম্যানকে শাস্তির আওতায় আনা হোক।’
রাজঘর ঈদগাহ মাঠে রোববার বাদ জোহর তিনজনের জানাজা হয়। জানাজায় দূর-দূরান্ত থেকে মুসল্লিরা যোগ দেন। পরে রাজঘর কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্রেনের ধাক্কায় দুমড়ে-মুচড়ে যায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ছবি: নিউজবাংলা
তদন্ত কমিটি
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে রেলওয়ের পক্ষ থেকে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি হয়েছে। রেলওয়ের সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামকে কমিটির প্রধান করা হয়েছে। সদস্যরা হলেন সহকারী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক ও অপারেশন) মো. আলাউদ্দিন, সহকারী প্রকৌশলী (সংকেত ও টেলিযোগাযোগ) আহাদ আলী খলিফা ও আখাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম মাহমুদুর রহমান।
তদন্ত কমিটির প্রধান আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা দুর্ঘটনার বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। কারা ঘটনার জন্য দায়ী, এ ব্যাপারে তদন্ত শুরু হয়েছে। আগামী তিন দিনের মধ্যে রেলওয়ে ঢাকা বিভাগীয় কর্মকর্তার কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।’