বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। বিশাল অংকের খেলাপি ঋণের ভারে জর্জরিত ছিল ব্যাংকগুলো। কয়েকটি বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা সামগ্রিকভাবে ব্যাংকগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা কমে এসেছিল। ঋণ দেয়ার জন্য ভালো উদ্যোক্তা খুঁজে পাচ্ছিল না ব্যাংকগুলো: যার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ এক অংকের ঘরে (১০ শতাংশের নিচে) নেমে এসেছিল।
এর মধ্যেই গত বছরের মার্চে ধেয়ে আসে মহামারি করোনারভাইরাসের ছোবল। তছনছ হয়ে যায় সবকিছু। স্থবির হয়ে যায় গোটা বিশ্ব। ওলোট-পালট হয়ে যায় সব হিসাব-নিকাশ। বিশ্ব অর্থনীতির মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও গভীর সংকটে পড়ে। করোনার ধাক্কা সামলে অর্থনীতিকে ঘুরে দাঁড় করাতে সোয়া লাখ কোটি টাকার ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। বর্তমানে সেই প্রণোদনার অংক বেড়ে ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায় ঠেকেছে।
এই প্রণোদনা ঋণের পুরোটাই বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো। সরকারের নির্দেশে দেশের অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে ব্যাংক খাত। প্রণোদনার ঋণ ছাড়া এ সময়ে অন্য ঋণ তেমন বিতরণ করেনি ব্যাংকগুলো। লকডাউনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গ্রাহকদের সেবা দিয়েছেন ব্যাংককাররা। এখন অবশ্য মহামারির ধকল কমতে শুরু করেছে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা কমতির দিকে।
এমন পরিস্থিতিতে ‘কেমন চলছে ব্যাংক খাত’ এ শিরোনামে নিউজবাংলার ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। সাক্ষাৎকারভিত্তিক এই প্রতিবেদনের প্রথম পর্বে দেশের ব্যাংকিং খাতের হালচাল নিয়ে কথা বলেছেন মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
সংকটাপন্ন অবস্থায় দেশের ব্যবসা–বাণিজ্য। করোনাকালীন সংকট থেকে উত্তরণে বড় ভূমিকা রাখছে ব্যাংক খাত। কিন্তু সেই ব্যাংক খাতের অবস্থা এখন কেমন?
করোনার আগেও ব্যাংকগুলো তেমন ভালো অবস্থায় ছিল না। বিনিয়োগে প্রবৃদ্ধি কম ছিল, খেলাপি ঋণও ছিল বাড়তির দিকে। ২০২০ সালের মার্চে করোনা শনাক্তের পর সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। টানা বন্ধের কারণে তৈরি পোশাকে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সার্বিক অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
কিন্তু আমাদের বড় প্রাপ্তি ছিল রেমিট্যান্স। প্রতি মাসে দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স আসা শুরু করে। বছরজুড়ে খেলাপি ঋণে ছাড় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে ব্যাংকগুলো রিকভারি করার যে পদক্ষেপ নেয় সেটা থমকে যায়। তখন আমরা কাউকে ঋণের কিস্তি দিতে বাধ্যও করতে পারিনি।
ফলে ব্যাংকগুলোর তেমন প্রভিশনিং করতে হয়নি। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল ন্যূনতম ১ শতাংশ প্রভিশন থাকতে হবে।
এরপর বিশ্বব্যাপী টিকা চলে আসার পর রপ্তানি বাড়তে শুরু হয়। পাশাপাশি আমদানিও বেড়ে যায়। তেলের বাজার অস্থির হয়ে যায়।
অনেক ভালো রেমিট্যান্স যেহেতু আসা শুরু করে সেহেতেু ডলারের দর অবমূল্যায়িত যেন না হয় এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার কেনা শুরু করে। প্রায় ৭/৮ বিলিয়ন ডলার কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিনে নেয়। ফলে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকার তারল্য মার্কেটে চলে আসে।
সরকার ১ লাখ কোটি টাকার উপর প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করল। ফলে বিভিন্ন খাত আবার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
অতিরিক্ত তারল্যর কারণে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হলেও সেটা ৭ শতাংশে নেমে যায়। আমানতে সুদহারও আড়াই থেকে ৩ শতাংশ হয়ে যায়।
করোনার মধ্যেও ব্যাংক কিন্তু কোনোদিন বন্ধ থাকেনি। সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে জীবন বাজি রেখে তারা সেবা দিয়ে গেছে।
করোনার ক্ষতি মোকাবিলায় ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রণোদনার অর্থ বণ্টন করছে ব্যাংক। কিন্তু বলা হচ্ছে বড় বড় ব্যবসায়ীদেরই প্রণোদনার অর্থ দেয়া হচ্ছে, বঞ্চিত হচ্ছে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প। প্রকৃত চিত্র কী?
সবসময়ই বড়রা প্রণোদনার অর্থ পেয়েছে বিষয়টি তেমন নয়। বড় ঋণগুলো দ্রুত ছাড় হয়েছে।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ঋণের জন্য কিছু পরিবর্তন করতে হয়েছে। এসব সংস্কারে কয়েকমাস পার হয়ে যায়। আর এ শিল্পের অধিকাংশ গ্রাহক গ্রামাঞ্চলের। করোনার বছরের মাঝামাঝি সময়ে বন্যা শুরু হয়। কিন্তু করোনায় ব্যাংকের সব শাখা খোলা ছিল না। গ্রাহকরাও ঠিকমতো আসতে পারেনি।
ব্যাংকগুলোর সিএসএমই পোর্টফোলিও সার্বিকভাবে তেমন ভালো না। এতে ব্যাংকের ঝুঁকি থেকে যায়। এজন্য ভালো গ্রাহক যাচাই করে ঋণ ছাড় করতে সময় লেগেছে। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কয়েকদফা সময় বাড়িয়ে সহায়তা করেছে যেন শতভাগ এ ঋণ ছাড় করা হয়। কিন্তু সবশেষ ১২টি ব্যাংক শতভাগ ঋণ ছাড় করেছে।
বর্তমানে ব্যাংক খাতে আলোচিত বিষয় আমানতের সুদহার। অর্থাৎ আমানতের সুদহার বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আপনাদের আপত্তি আছে, যা ব্যাংকার্স সভায় স্পষ্ট করেছেন। এই নির্দেশনা পরিপালনে ব্যাংক খাতের চ্যালেঞ্জ কী?
আমানতে সুদহার মুক্ত বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দেয়া উচিত। যখন ঋণের সুদ হার নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল, তখন আমরা বলেছিলাম বাজার ব্যবস্থার ওপর ছেড়ে দিতে। বাজার ঠিক করবে সুদহার কেমন হবে। পরে ৯ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও সেটা এখন ৭ শতাংশে নেমে গেছে। ঋণের চাহিদা কমতে কমতে সাড়ে ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। আমাদের দেশে অনেকগুলো ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এজন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হয়েছে।
এখন মূল্যস্ফীতি ৫ থেকে ৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির সমান আমানত দিতে আমার রাজি আছি। কিন্তু সরকার কাদের জন্য এটা করতে চাচ্ছে? সুদহারের ওপর নির্ভর করে যাদের জীবিকা চলে, যাদের মূল আয় কমে গেছে- কিন্তু ব্যাংকের সঞ্চয়ের ওপর চলতে হয়। এসব মানুষের জন্য এ সুবিধার কথা চিন্তা করেছে সরকার।
সঞ্চয়পত্র কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার করা হয়েছে। একজন ৫০ লাখের বেশি কিনতে পারবে না, কিন্তু ব্যাংকে তো এক একজন বিভিন্ন ব্যাংকের মোটা টাকা আমানত রাখতে পারবে। কারণ, এখানে কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার করা নেই।
এজন্য আমরা যাদের সুবিধা দেয়ার জন্য এটা বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছি, সে সুবিধা নিয়ে যাবেন বড় বড় আমানতকারীরা।
আবার কখনো যদি মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ে এবং ব্যাংকের তারল্য কমে যায়, তখন আমানতের চাহিদা বেড়ে যাবে। তখন ব্যাংকের মুনাফায় প্রভাব পড়বে।
অভিযোগ করা হয়, ব্যাংক পরিচালকরা ২৫-৩০ ভাগ পর্যন্ত মুনাফা নেন। কিন্তু আমানতকারীদের মুনাফা দেয়ার ক্ষেত্রেই গড়িমসি। আসল বিষয়টা স্পষ্ট করবেন?
এখন ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঋণ দিতে ব্যাংকের আড়াই শতাংশ চলে যায়। থাকে সাড়ে ৬ শতাংশ। ব্যাংক যদি প্রফিট নাও করতে চায়, যদি খেলাপি ঋণ না থাকে তারপরও সাড়ে ৬ এর বেশি ব্যাংক আমানতে সুদ দিতে পারবে না। কারণ ৯ এর বেশি সুদ নিতে পারছি না।
ব্যাংকে শেয়ারহোল্ডাদের অংশ ১০ শতাংশ। বাকি ১০ শতাংশ কিন্তু আমানত। এর ওপরে কীভাবে ২০ শতাংশ দেয়া যাবে?
যখন কোনো লিকুইডেশন হয় তখন সবার আগে আমানতকারীরা টাকা পাবে। শেয়ারহোল্ডাররা সবশেষ টাকা পাবে। এখানে ঝুঁকি বেশি।
আমানতকারীদের আমরা বঞ্চিত করতে চাই– এ ধারণা ঠিক না। একসময় ১১ থেকে ১২ শতাংশ আমানতে সুদ দেয়া হয়েছে। তখন ঋণের সুদ ছিল ১৮ বা ১৯ শতাংশ।
খেলাপি ঋণ দেশের ব্যাংক খাতের এখনও অন্যতম প্রধান সমস্যা। এ সংস্কৃতি থেকে বের হতে কী করা দরকার। ব্যাংক এবং গ্রাহকের দায় কোথায়?
খেলাপি ঋণ থেকে উত্তরণে ব্যাংকিং কোম্পানি আইনে কিছু পরিবর্তন হচ্ছে বলে শুনেছি। যারা টাকা নিচ্ছে তারা অনেক সচেতন। টাকা আদায়ে যদি মামলা করা হয় সেক্ষেত্রে ৭/৮ বছর পার হয়ে যায়। ৫/৬ বছর পার হয়ে গেলে একজন খেলাপি গ্রাহক যখন বুঝতে পারে তার পক্ষে রায় আসবে না, তখন সে দেশ ছেড়ে চলে যায়। এ ধরনের ঘটনা ঘটছে।
আমরা ব্যাংককাররাও অসম প্রতিযোগিতার কারণে গ্রাহকদের খারাপ করে ফেলছি। কারণ এক ব্যাংক ঋণ না দিতে চাইলে অন্য ব্যাংক প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ঋণ দিচ্ছে। টাকা এমন জিনিস এর প্রতি মোহ থাকবে। এসব বিষয় দেখতে হবে।
অনেকে স্বল্পমেয়াদে ঋণ দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করছে। ঋণ নিয়ে যে বিনিয়োগ করে সেখান থেকে গ্রাহকের আয় না হলে ঠিকমতো ঋণ শোধ করতে পারবে না। ফলে খেলাপি হয়ে যায়।