মৌসুম প্রায় শেষের দিকে। উপকূলীয় সাগর বা নদ-নদীতে এবার এখন পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত ইলিশ ধরা পড়েনি। দু-একটি ট্রলার কিছু ইলিশ পেলেও অধিকাংশই ফিরেছে খালি হাতে। এতে জেলেরাও বাড়ি ফিরেছে শূন্য হাতেই।তবে পাথরঘাটার একটি ট্রলার একবারে ১৭০ মণ ইলিশ শিকার করলে তোলপাড় তৈরি হয়। একসঙ্গে এত মাছ পাওয়ায় ট্রলারের মাঝি ইমরান হোসাইনকে অর্ধলক্ষ টাকা মূল্যের স্বর্ণের চেন উপহার দেন ট্রলার মালিক এনামুল হোসাইন।
ইমরান হোসেনের সঙ্গে কথা হয় ইলিশ শিকার নিয়ে। তিনি জানান, মৌসুম শুরুর আগেই একজন মাঝি নেতৃত্ব দিয়ে জেলেদের সংগঠিত করেন। বড় ট্রলারে ১৮ জন, মাঝারি ট্রলারে ১৪ থেকে ১৬ জন এবং ছোট ট্রলারে ৮ থেকে ১২ জন জেলে থাকে।
দলে একজন বাবুর্চি, একজন ইঞ্জিনচালক, একজন সহকারী মাঝি ও বাকি ১৪ জন জেলে থাকেন।
এরপর ট্রলার মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব জেলেকে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা দাদন দিয়ে এক মৌসুমের জন্য মাছ শিকার করতে চুক্তিবদ্ধ করা হয়।
শর্ত অনুযায়ী এক মৌসুমে ওই জেলেরা অন্য কোনো ট্রলারে মাছ শিকারে যেতে পারবেন না। এরপর সমুদ্রযাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে জেলেদের ১০ দিনের খাবার, ইঞ্জিনের তেল ও বরফ কিনে দেন।
চুক্তি থাকে ওই ট্রলারে যে মাছ পাওয়া যাবে সব মাছ আড়তদারকে দিতে হবে। মাছ শিকার করে ফেরার পর নিলামে তোলা হয়। এরপর নিলামে ডাকা সর্বোচ্চ দামে দাদন দেয়া আড়তদার এসব মাছ কিনে নেন।যেভাবে শূন্য ভাগি জেলেরা
মাঝি ইমরান জানান, ৫০ লাখ টাকার মাছ বিক্রির পর হিসাব হয় ট্রলারমালিকের সঙ্গে। ৫০ লাখ টাকা থেকে প্রথমেই বাজার, ডিজেলসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ ৭০ হাজার টাকা কেটে নেয়া হয়। বাকি টাকার অর্ধেক ট্রলারমালিকের।
এরপর যা থাকে তা ২০ ভাগ করা হয়। এই ২০ ভাগের মধ্যে ১৬ জন জেলের এক ভাগ করে ১৬ ভাগ, মাঝির ২ ভাগ এবং বাবুর্চি ও ইঞ্জিনচালকের ১ ভাগ।
অর্থাৎ ৫০ লাখ টাকার ৭০ হাজার বাজার খরচের পর একেকজন জেলে পেয়েছেন ১ লাখ ২৪ হাজারের কিছু বেশি টাকা। মাঝি পেয়েছেন ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা।কিন্তু যখন মাছ শিকারে গিয়ে শূন্য হাতে ফিরতে হয়, তখন বাজার খরচ ট্রলার মালিকেরই গচ্চা যায়। আর জেলেদের টানা এক সপ্তাহ সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে খালি হাতে ফিরতে হয় বাড়িতে অপেক্ষমাণ স্বজনদের কাছে।
বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘার নজরুল মাঝি। ৪০ বছর ধরে তিনি ট্রলারের জেলে। গতরে খেটে সাগরে মাছ শিকারই জীবিকার উৎস।
নজরুল বলেন, ‘মোগো ট্রলার নাই, মোরা যারা জাইল্লা, মোরা সবাই শূন্য ভাগি। এই বচ্ছর তিনডা খ্যাপে গেছিলাম, একফিরও বাজার খরচাও ওডে নাই, মালিকেই বা কিদ্দা মোগো টাহা দেবে।
‘পাহাড়ের নাহান (মতন) ঢেউ, নোনাপানি, আর ঝড় বইন্নার মইদ্দে মাছ ধরতে যাইয়া যহন মাছ না পাইয়া ঘাডে (তীরে) আই, তহন মোনডা খারাপ অইয়া যায়। গুরাগারা চাইয়া থাহে আব্বো (বাবা) সাগইরদা মাছ ধইরা টাহা পাইয়া এডা ওডা (এটাসেটা) কিন্না লইয়া আইবে, যহন খালি আতে ফেরন লাগে তহন খুব খারাপ লাগে।’৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞার সময় জেলেদের জীবন-জীবিকা নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করে বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন 'মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন'।
এটির জ্যেষ্ঠ কর্মসূচি ব্যবস্থাপক শেখ গিয়াস উদ্দীন বলেন, ‘গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে মাছের উৎপাদন ৪-৫ গুণ বাড়লেও জেলেদের জীবনমানের কোনো উন্নতি হয়নি। সামগ্রিকভাবে জেলেরা বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার। তাদের মধ্যে যারা সমুদ্রে মাছ ধরেন, তাদের অবস্থা আরও শোচনীয়। অনেকের স্থায়ী ঘরবাড়িও নেই। কোনোভাবে অন্যের জায়গায় মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন।’
তিনি বলেন, ‘এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেশি। সেখানে বছরের দীর্ঘ একটি সময় মানুষের কাজ থাকে না। এসব জেলেকে বছরের একটা বড় সময় বেকার বসে থাকতে হয়।
‘এ সময়ে তাদের সঞ্চয় বলে কিছু থাকে না। ফলে মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে তাদের জীবন বাঁচাতে হয়। তাই অনেক সময় তারা কম দামে মাছ আগাম বিক্রি করে দেন।’
জেলেদের মহাজনদের ঋণের চক্র থেকে বের করতে তাদের আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি বিকল্প জীবিকার ব্যবস্থা করারও তাগিদ দেন এই গবেষক।
বলেন, ‘উপকূল ও চরাঞ্চলের অনেক স্থানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অভিভাবকরা সন্তানদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করতে পারে না। এ বিষয়েও সরকারের দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।’
উপকূলীয় ট্রলারমালিক সমিতির সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘শূন্য ভাগ প্রচলন হয়ে গেছে। যুগের পর যুগ ধরে এই পন্থায়ই জেলেরা মাছ শিকার করে আসছে।’
তিনি বলেন, ‘মৌসুমে উপকূল থেকে দেড় হাজারেরও বেশি ট্রলার মাছ শিকারে যায়। এই সিজনে এখন পর্যন্ত পাথরঘাটার হাতে গোনা ৪-৫টি ট্রলার মাছ পেয়েছে। সব মিলিয়ে ২০ থেকে ২২টি ট্রলার লোকসান কাটিয়ে লাভবান হয়েছে। ইলিশ ধরা পড়লে মালিকের পাশাপাশি জেলেরাও একটু স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচতে পারে।’