ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গ্রাহকদের মামলা করার পর বেরিয়ে আসছে অনিয়মের নানান তথ্য।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গ্রাহক ক্ষোভ দানা বাঁধতেই হঠাৎ করে নাজমুল আলম রাসেলকে সরিয়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) পদে বসানো হয় আমানউল্লাহ চৌধুরীকে ।
মূলত গ্রাহকদের ১১০০ কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা আড়াল করতে পরিকল্পিতভাবে আমান উল্লাহকে এ পদে বসানো হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। আমান দায়িত্ব নেয়ার পরপরই গ্রাহকদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরাতে সাবেক সিওও রাসেলের বিরুদ্ধে ৬৬৩ কোটি আত্মসাতের প্রচার চালায় মালিকপক্ষ।
আমান উল্লাহ চৌধুরীকে আলোচিত এই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়ার চিঠির একটি অনুলিপি পেয়েছে নিউজবাংলা। এতে দেখা যায়, ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন গত ৩০ জুন নিয়োগপত্রে সই করেন। পরদিন ১ জুলাই ই-অরেঞ্জের সিওও হিসেবে যোগ দেন আমান।
প্রতিষ্ঠানে যোগ দিলেও গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পর্যন্ত তেমন কেউ চিনতেন না আমান উল্লাহ চৌধুরীকে। জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য দেয়া তথ্য ফরমে আমান উল্লাহ চৌধুরীর (৪৩) শিক্ষাগত যোগ্যতার জায়গায় লেখা রয়েছে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণকারী। এর বাইরে পরিচয় তুলে ধরার মতো কিছুই নেই আমানের।
তবে ই-কমার্স খাতসংশ্লিষ্টদের কাছে আমান চতুর ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। ই-অরেঞ্জের সাধারণ গ্রাহক ও ব্যবসায়ীদের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়ে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স সাইট আমাজনের ভুয়া বাংলাদেশ সংস্করণ চালু এবং এর মাধ্যমে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে আমান উল্লাহর বিরুদ্ধে।
ই-অরেঞ্জে আমান উল্লাহ চৌধুরীর নিয়োগপত্র
গুলশান এলাকা থেকে ১৯ আগস্ট আমান উল্লাহকে গ্রেপ্তার করে গুলশান থানা পুলিশ। এ সময় তার কাছ থেকে ২৬টি ক্রেডিট কার্ড, নগদ ১৬ লাখ টাকা এবং একটি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়।
জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ফরমে আমান উল্লাহর জন্মতারিখ উল্লেখ রয়েছে ১৯৭৮ সালের ৮ মে। বাবা মো. মোসাদ্দেক চৌধুরী, মা শেফালী চৌধুরী এবং স্ত্রীর নাম মাহমুদা আফরোজ লাকী।
স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে বাড়ি- ৪/৩, ফ্ল্যাট ডি-১, রোড-১৩, গুলশান উল্লেখ করা হয়েছে। মামলার এজাহারে তার বর্তমান ঠিকানা দেখানো হয়েছে কুনিপাড়া, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল। তবে ই-অরেঞ্জের সিওও পদে ইস্যু করা নিয়োগপত্রে ঠিকানা রয়েছে প্লট-১২০৯, রোড-৮, এভিনিউ ৯/এ, মিরপুর ডিওএইচএস, ঢাকা-১২১৯।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ই-অরেঞ্জে আমান উল্লাহর মাসিক বেতন ধরা হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এর বাইরে প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার আওতায় তাকে দেয়া হতো মাসভিত্তিক অতিরিক্ত সাড়ে তিন হাজার টাকা মোবাইল ফোনের বিল এবং প্রতিদিন দুপুরে বিনা মূল্যে খাবার। ছিল বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহারের সুবিধা।
ই-অরেঞ্জে সিওও পদে আমান উল্লাহ যোগ দেয়ার পর একে একে ঘটতে থাকে নাটকীয় ঘটনা। প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকদের ৬৬৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলে সাবেক সিওও নাজমুল আলম রাসেলসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা হয় ১১ আগস্ট। এ মামলার বাদী হন নতুন সিওও আমান উল্লাহ চৌধুরী। আর মালিকানা বদলের নাটক সাজানো হয় ১৯ জুলাই।
তার আগেই এক লাখ গ্রাহকের প্রায় ১ হাজার ১০০ কোটি টাকার সিংহভাগ ধাপে ধাপে তুলে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেন আমান।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলার তদন্তে যুক্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে জানান, গত ৩০ জুন পর্যন্ত একটি ব্যাংক হিসাবে জমা পড়া প্রায় ৩৯২ কোটি টাকার মধ্যে ৩৮৯ কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়। অন্য একটি ব্যাংক হিসাবে জমা প্রায় ৬২১ কোটি টাকার মধ্যে ৬২০ কোটি টাকাও তুলে নেয়া হয়।
এভাবে ই-অরেঞ্জের ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা লোপাট হতে থাকে আমান উল্লাহ চৌধুরী সিওও পদে যোগ দেয়ার পর। তবে এর সমস্ত দায় চাপানো হয় সাবেক সিওও নাজমুল আলম রাসেলসহ আরও কয়েকজনের ওপর।
ই-অরেঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের পক্ষে গুলশান থানায় করা মামলার বাদী মো. তাহেরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মূলত আমান উল্লাহ চৌধুরীকে ই-অরেঞ্জের সিওও পদে বসানো হয়েছে মালিকপক্ষের টাকা হাতানোর ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জন্য।
‘আমান সিওও পদে যোগ দেয়ার পরপরই ই-অরেঞ্জের গ্রাহকদের আস্থার জায়গাটি ধূলিসাৎ হতে থাকে। একদিকে তিনি মালিকপক্ষের হয়ে গ্রাহকদের পণ্য বা রিফান্ড দেয়ার আশ্বাস দিয়ে সময়ক্ষেপণ করেছেন, অন্যদিকে এই সময়ক্ষেপণের সুযোগ নিয়ে ই-অরেঞ্জের লেনদেন বন্ধ করাসহ মালিকপক্ষকে টাকা লোপাট এবং তাদের কাউকে কাউকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছেন।’
তাহেরুল ইসলাম বলেন, ‘সংক্ষুব্ধ কোনো গ্রাহক পাওনা টাকা ফেরত চাইলে তিনি (আমান) হুমকিধমকি দিতেন। বলতেন, তোরা এক টাকাও পাবি না। পারলে কিছু করিস। তার এ ধরনের আচরণে গ্রাহকের অসন্তুষ্টি চরমে উঠে গিয়েছিল।’
ই-অরেঞ্জের ক্ষতিগ্রস্ত এক গ্রাহক জামান উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমান উল্লাহ চৌধুরী ই-অরেঞ্জে যোগ দিয়েছিলেন মালিকপক্ষকে বাঁচাতে এবং সাবেক সিওও নাজমুলকে ফাঁসাতে। তিনি যোগ দিয়েই একের পর এক নাটক সৃষ্টি করেন। ওয়েবসাইটে গ্রাহকদের উদ্দেশে একের পর এক নোটিশ দিতে থাকেন। টাকা আত্মসাতের অভিযোগের মামলা করেন। আসলে এর সবই ছিল নাটক।’
ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের কয়েকজন জানান, আমান উল্লাহ চৌধুরী নিজেকে বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স সাইট আমাজন-এর বাংলাদেশ সংস্করণের পরিচালক হিসেবে পরিচয় দিতেন। তিনি একটি ‘ডোমেইন’ কিনে আমাজন বাংলাদেশ লিমিটেড নাম জুড়ে দেন।
চতুর আমান উল্লাহ চৌধুরী রেজিস্ট্রার অফ জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস (আরজেএসসি) এর কয়েকজন কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে সেই নামটির নিবন্ধনও নিয়েছেন। তবে তাকে নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনার মুখে সাইটটির বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধ ছিল।
পরে আমান উল্লাহ চৌধুরী নজর দেন ই-কমার্স সাইট খোলার দিকে। ই-অরেঞ্জে যোগ দেয়ার আগে তিনি ‘নগদহাট ডটকম’ নামে ফেসবুকভিত্তিক নামসর্বস্ব একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের প্রোপাইটর হিসেবে কাজ করতেন।
ইলেকট্রনিক কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. সাহাব উদ্দিন শিপন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ লোকটিকে (আমান উল্লাহ চৌধুরী) ই-অরেঞ্জে যোগ দেয়ার আগে আমি চিনতাম না। তার নগদহাট ও আমাজন বাংলাদেশ লিমিটেড ই-ক্যাবের মেম্বারও না। আবার ই-অরেঞ্জ মেম্বার হলেও এর মালিকপক্ষ ছাড়া সিওও আমান উল্লাহ চৌধুরীর কোনো বায়োডাটা বা বায়োগ্রাফি আমাদের কাছে নেই।’
আমাজন বাংলাদেশ লিমিটেড সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কপিরাইট আইনে একটি প্রতিষ্ঠানের সেইম লোগো ও সেইম নাম অন্য কারও ব্যবহারের সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অজান্তে কেউ এটা করে থাকলেও যে প্রতিষ্ঠানের গুডউইল ব্যবহার করা হয়, তারা জানতে পারলে এবং অভিযোগ পেলে তা হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’
আমাজন বাংলাদেশ লিমিটেডের নাম কীভাবে নিবন্ধন হলো জানতে চাইলে আরজেএসসির অতিরিক্ত নিবন্ধক (যুগ্ম সচিব) সন্তোষ কুমার পণ্ডিত নিউজবাংলাকে জানান, ‘আইনে বলা আছে, সিমিলার নামে হবে না। যদি একই রকম হয় বা কাছাকাছি নামের হয় কিংবা আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিষ্ঠান হয় তাহলে আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন করা যাবে না। সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের নামেও কেউ কোনো প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন করতে পারবে না। এটা করা হয়েছে যাতে কোনো একজন আরেকজনকে প্রতারিত করতে না পারে। তবে কেউ করলে তার আগে-পরে কিছু যোগ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমান উল্লাহ চৌধুরীর ক্ষেত্রে কী হয়েছে- আসলে ভেতরের খবরটা আমি জানি না। তবে নিবন্ধনের যেটা নিয়ম সেটা হলো- কেউ যদি এ ধরনের প্রতিষ্ঠিত কোনো কোম্পানি বা গ্রুপের নাম ব্যবহার করতে চায় সেখানে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অনাপত্তি ছাড়া করা যাবে না। এটা হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে তারা অভিযুক্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারে।’