বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

টাকার মান এখন পাকিস্তানি রুপির দ্বিগুণ

  •    
  • ৩০ আগস্ট, ২০২১ ০৮:০৭

বাংলাদেশের ১০০ টাকার জন্য এখন ১৯৫ পাকিস্তানি রুপি খরচ হচ্ছে। অথচ স্বাধীনতার পরপর চিত্রটা ছিল উল্টো। তখন পাকিস্তানের ১০০ রুপির মান ছিল বাংলাদেশের ১৬৫ টাকা।

গত কয়েক দিনে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের বিপরীতে টাকার মান খানিকটা কমেছে। তারপরও বাংলাদেশি মুদ্রার মান পাকিস্তানের মুদ্রা রুপির দ্বিগুণ।

আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে বৃহস্পতিবার প্রতি ডলারের জন্য ৮৫ টাকা ২০ পয়সা গুনতে হয়েছে। আর প্রতি ডলারের জন্য খরচ করতে হচ্ছে ১৬৬ দশমিক ৭৭ পাকিস্তানি রুপি।

এ হিসাবে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের ১০০ টাকার জন্য এখন ১৯৫ পাকিস্তানি রুপি খরচ হচ্ছে। অথচ স্বাধীনতার পরপর চিত্রটা ছিল উল্টো। তখন পাকিস্তানের ১০০ রুপির মান ছিল বাংলাদেশের ১৬৫ টাকা।

উন্নয়নে পাকিস্তানকে বাংলাদেশের ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখন আর নতুন কোনো তথ্য নয়। বছর বছর ‍দুই দেশের মধ্যে নানা সূচকে বাড়ছে ব্যবধান। আর এর প্রভাব পড়েছে দুই দেশের মুদ্রার মানেও।

অর্থনীতি বা উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনা উঠলেই পাকিস্তানের মন্ত্রী, রাজনীতিক, অর্থনীতিবিদরা এখন বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ টেনে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেন। টেলিভিশন টকশো, জাতীয় দৈনিকগুলোতে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়।

২০১৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগ ও মুদ্রানীতি বিভাগের যৌথ এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি প্রথম মুদ্রা বিনিময় হার নির্ধারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সে সময় যুক্তরাজ্যের এক পাউন্ড স্টার্লিংয়ে পাওয়া যেত বাংলাদেশি ১৮ দশমিক ৯৬ টাকা।

তখন পাউন্ডের বিপরীতে পাকিস্তানের মুদ্রার মান ছিল ১১ দশমিক ৪৩ রুপি। সেই হিসাবে তখন এক পাকিস্তানি রুপির বিপরীতে বাংলাদেশকে খরচ করতে হতো ১ দশমিক ৬৫ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ আশরাফ আলী মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ে কাজ করতেন। ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ’ শিরোনামে একটি বইও লিখেছেন তিনি।

সেই বইতে তিনি লিখেন, ‘ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার নির্ধারণ হয় আশির দশকের শুরুর দিকে। তবে ১৯৭২ সালেও আমরা ডলারের সঙ্গে টাকার একটি বিনিময় হার বের করেছিলাম। তখন এক ডলারের বিপরীতে বাংলাদেশের ৭ দশমিক ৮৬ টাকা এবং পাকিস্তানের ৪ দশমিক ৭৬ রুপি ছিল।’

তিনি বলেন, ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির দীর্ঘকাল পরও পাকিস্তানের মুদ্রা বেশ শক্তিশালী ছিল। তবে সেই অবস্থানে এখন আর নেই দেশটি। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ঘাটতি, বৈদেশিক ঋণ ও মূল্যস্ফীতির চাপে রুপির অবস্থান এখন বেশ নাজুক। টাকা এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শক্তিশালী মুদ্রায় পরিণত হয়েছে।

সৈয়দ আশরাফ আলী বলেন, ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলেও বাংলাদেশে নিজস্ব মুদ্রার প্রচলন শুরু ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ। এর আগে পাকিস্তানের রুপি দিয়েই হতো লেনদেন। তবে বৈদেশিক লেনদেনের জন্য বিনিময় হার নির্ধারণ করতে হয়েছিল টাকা প্রচলনের আগেই।

তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে শর্ত দেয়া হতো যে, একবার একটি বিনিময় হার ঠিক করা হলে আইএমএফকে না জানিয়ে সে হার পরিবর্তন করা যাবে না। এ ধরনের বিনিময় হার নির্ধারণকে ফিক্সড রেট পদ্ধতি বলা হয়। বর্তমানে ফ্লোটিং রেট পদ্ধতিতে (ভাসমান মুদ্রা বিনিময় হার) প্রতিনিয়ত মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তন হচ্ছে।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার পরের বছর পাকিস্তানে চালু হয় নিজস্ব মুদ্রা রুপি। সে সময় থেকে দেশটি ব্রেটন উডস পদ্ধতিতে বিনিময় হার বেঁধে দিত। তখন এক ডলার কিনতে তাদের ব্যয় করতে হতো তিন রুপির কিছু বেশি।

বর্তমানে এক ডলার কিনতে পাকিস্তানি মুদ্রায় খরচ হয় ১৬৬ দশমিক ৭৭ রুপি। সেখানে বাংলাদেশের খরচ হয় ৮৫ টাকা ২০ পয়সা।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে বলা হয়, দীর্ঘদিন সামরিক শাসনে থাকার কারণে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন বাধাগ্রস্ত হয়। আর অর্থনীতি দুর্বল অবস্থানে যাওয়ার ফলে একের পর এক দেশটির মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটতে থাকে।

২০০৮ সালকে ধরা হয় পাকিস্তানের রুপির বিনিময় হারের পতনের বছর। ওই বছর মূল্যস্ফীতি ও চলতি হিসাবের ঘাটতি বেড়ে যাওয়ায় ডলারের বিপরীতে রুপির দর ৬১ থেকে এক ধাক্কায় ৭৯ রুপিতে পৌঁছায়।

ওই বছরের আগস্টে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের পদত্যাগের মধ্য দিয়ে রুপির পতনের সাময়িক অবসান ঘটে।

গত এক দশকে মুদ্রার মান অর্ধেকে নেমেছে পাকিস্তানে। যদিও এ সময়ে পাকিস্তানকে সুইডেন বানানোর স্বপ্ন দেখানো হয়েছে।

২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এক ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানকে ব্যয় করতে হয়েছে ১০৪ থেকে ১০৫ রুপি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এক ডলারের দর ছিল ১০৯ রুপি।

গত তিন অর্থবছরেই পাকিস্তান প্রায় ৭ লাখ কোটি রুপির বাজেট হয়েছে। প্রতিবারই ৩ লাখ কোটি রুপির বিশাল ঘাটতি ধরা হয়েছে।

চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ কোটি টাকার মতো।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিক দিয়েও বাংলাদেশ এগিয়ে। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) গত জুলাই মাসে পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ।

পাকিস্তানের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ বাংলাদেশের রিজার্ভের অর্ধেকের কম।

বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ছিল ৪৮ দশমিক ০৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে পাকিস্তানের রিজার্ভ ছিল ২২ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন ডলার।

অর্থনীতির আরেক গুরুত্বপূর্ণ সূচক মাথাপিছু আয়েও পাকিস্তানের দ্বিগুণ বাংলাদেশ। পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ১৬৮ ডলার। আর বাংলাদেশের ২ হাজার ২৭৭ ডলার।

দুই দেশের অর্থনীতির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে অর্থনীতির গবেষক ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআরআইবি) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে। তবে এতে আত্মতুষ্টিতে না ভুগে আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে।

‘আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই আরও সংস্কার করতে হবে। রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে; কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করার দিন শেষ। আমাদের এখন সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া-ভিয়েতনামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে। এ দেশের তুলনা চলে ভারতের মতো দেশের সঙ্গে।’

গত জুনে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রামানিয়াম একটি নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের উজ্জ্বল মডেল। ভারত ও পাকিস্তানের জন্য মডেল হতে পারে দেশটি। ৫০ বছরে বাংলাদেশ যে উন্নয়ন করেছে, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। সবার চোখে পড়ার মতো।’

প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে লেখা ওই নিবন্ধে বাংলাদেশের এগিয়ে চলা নিয়ে মুগ্ধ হয়ে এ মন্তব্য করেছেন তিনি।

বিশ্বব্যাপী সমাদৃত বিশ্লেষণ ও মতামতভিত্তিক ওয়েবসাইট প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে ১১ জুন অরবিন্দ সুব্রামানিয়ামের নিবন্ধটি প্রকাশ হয়েছে। সাইটটিতে বিশ্বের খ্যাতিমান লেখকেরা লিখে থাকেন।

নিবন্ধে অরবিন্দ সুব্রামানিয়াম লিখেন, ‘একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বছরের পর বছর ধরে বিদেশি সহায়তা ও রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল এবং উদ্বাস্তু ও অভিবাসীদের বসবাসের কারণে একটি গরিব দেশ হিসেবেই এত দিন বাংলাদেশকে জেনে এসেছি। ২০১৪ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক জিয়া হায়দার রহমানের প্রথম উপন্যাস ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো পড়ে বাংলাদেশকে ‘দুঃখের ঝুঁড়ির দেশ’দেশ হিসেবেই জেনেছি।

‘কিন্তু এই বাংলাদেশ এখন আর সেই বাংলাদেশ নেই। স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে বাংলাদেশ এখন অতি দ্রুত বিকাশমান একটি দেশ হিসেবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এটা একটা বিস্ময়, অলৌকিক ঘটনা মনে হচ্ছে আমার কাছে।’

এ বিভাগের আরো খবর