মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেয়া জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলার বিচারে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আদালতে কী হয়েছিল, তা তুলে ধরে ন্যায়বিচার না পাওয়ার আক্ষেপের কথা জানালেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
বিচারিক আদালতে খালাস পাওয়া চার আসামি কার্যত বিচারিক আদালত পরিচালনা করতেন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, উচ্চ আদালত থেকে যে রায় এসেছে, সেটাও প্রত্যাশিত ছিল না। তার মতে, সেই রায় ছিল ‘পার্ভার্ট’ বা বিকৃত।
মন্ত্রী জানান, বিচারিক আদালত যাদের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিল, তাদের মধ্যে পলাতক একজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকিদের খালাস দেয়া হয়েছিল হাইকোর্টে। পরে আপিল বিভাগে গিয়ে সেই রায় বাতিল করাতে সক্ষম হন তিনি।
‘বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার: আইনি পর্যালোচনা’ শীর্ষক বিশেষ আলোচনা সভার আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের আইন অনুষদ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ কিউ এম মাহবুবের সভাপতিত্বে আলোচনায় প্রধান অতিথ ছিলেন আইনমন্ত্রী।
হত্যা, বিচারে বিলম্ব, বিচারিক আদালতে যা হয়েছে
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার আড়াই মাস যেতে না-যেতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে গুলি করে হত্যা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ এম কামারুজ্জামান ও অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার মতো এই হত্যায় জড়িতদেরও বিচার হয়নি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিচারে গতি পায়। তবে ওই সরকারের আমলে রায় হয়নি।
ঘটনার ২৯ বছর পর ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালত এই মামলার রায় ঘোষণা করে। সে সময় ক্ষমতায় বিএনপি-জামায়াত জোট।
বিচারক তিন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
চার আসামি কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও নুরুল ইসলামকে দেয়া হয় খালাস।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘এরাই (সে সময়) কোর্ট চালায়। এরাই জজ সাহেবকে বলে এটা করেন, জেরা করেন সাক্ষীদের। আর যা বলে তাই (করেন বিচারক)।
এই হত্যা মামলার বিচারে আইনজীবী হিসেবে আনিসুল যুক্ত হন ২০০২ সালের ২৮ অক্টোবর। তিনি বলেন, ‘আমার পিতা (সিরাজুল হক) মারা যাওয়ার পর আমাকে জেল হত্যা মামলার দায়িত্ব দিয়ে গেলেন। আমাকে কৌঁসুলি নিযুক্ত করা হয়েছিল। তার পরের বছর মার্চ মাস পর্যন্ত।’
তবে আদালতে যা হচ্ছিল, তা দেখে বিচার-প্রক্রিয়া থেকে দূরে সরে দাঁড়ান আনিসুল। বলেন, ‘তখন মার্চ মাসের ২৪ তারিখ, ২০০৪ সাল। আমি আমার প্রসিকিউশন টিম নিয়ে পদত্যাগ করি। আমি তখন বলি যে আমরা বিচার পাব না। আমরা সেদিন বিচার পাইনি।’
বিচারিক আদালত সে সময় মৃত্যুদণ্ড দেয় রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী শাহ ও দফাদার মো. আবুল হাশেমকে।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, কর্নেল (অব.) খন্দকার আবদুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, কর্নেল (অব.) এম বি নূর চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) আহম্মদ শরিফুল হোসেন, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন (অব.) কিশমত হাশেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার।
হাইকোর্টে যা হয়েছিল
মন্ত্রী বলেন, “যখন এটা ২০০৮ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনে আসে, আমি জানি কী ওনাদের আইন। ওনারা হয়তো অনেক বেশি আইন জানেন। পরে প্রমাণিত হয়েছে ওনারা আইন জানেন না।
দ্বৈত বেঞ্চ সকলকে খালাস দিয়ে একজনকে রেখেছে, যাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকলকে খালাস দিয়েছে। তখন আমি আপিল বিভাগে যাই, তখন আমাকে বলে ‘দিস ইজ এ প্রিপাস্টেরাস জাজমেন্ট’। আমি বলি সে জন্যই তো আপনাদের কাছে আসা।”
মন্ত্রী বলেন, ‘আমাকে বলে (বিচারপতি) আপনি কী চান? তখন আমি বললাম, বিচারিক আদালত যে রায় দিয়েছে, সেটাই বহাল রাখেন। সেভাবে বহাল রেখে হাইকোর্ট ডিভিশনের পার্ভার্ট রায় বাতিল করল।’
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা প্রসঙ্গ
আলোচনার বিষয় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা নিয়েও দীর্ঘ বক্তব্য রাখেন আইনমন্ত্রী।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের আমলে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বিচারের পথ খোলে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টের রায় এলেও আপিল বিভাগের রায় আসেনি।
আইনমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় বিভক্ত রায় হয়েছিল (হাইকোর্টে)। একজন বিচারপতি এম রুহুল আমীন ১০ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন। আর বিচারপতি এ বি এম খাইরুল হক ১৫ জনকেই মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। তাই আইন অনুযায়ী এটা তৃতীয় বিচারক ফজলুল করিমের কাছে যায়। সেখানে তিনি ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন। সেটি পরে আবার আপিল বিভাগে চলে যায়। তবে ২০০১ সালে এটি আবার থেমে যায়।’
সে সময় বিএনপি ক্ষমতায় আসে। আপিল বিভাগে নতুন বিচারক নিয়োগ না দেয়ায় আর শুনানি হয়নি।
আইনমন্ত্রী বলেন, “তখন আমার পিতা মওদুদ আহমদ সাহেবকে ফোন করেন। তখন আমি ওনাকে বলি, ‘দেখেন সংবিধানে তো আছে একটা মামলা শোনার জন্য বিচারক দেয়া যায়। আপিল বিভাগে বিচারকসংকট আছে, আপনি এই মামলার জন্য দুজন বিচারক দেন।’
“মওদুদ সাহেব আমার কথা শোনেননি। এই মামলাটি ২০০৬ সাল পর্যন্ত শুনানি করেননি।”
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর আপিল বিভাগে নতুন বিচারপতি নিয়োগ দিলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি শুরু হয়। কিন্তু পরে থেমে যায়। এরপর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তা আবার শুরু হয়।
২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে।
২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি রাতে সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও মুহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। আরেক খুনি ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয় ২০২০ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে।
এখনও পাঁচ খুনি ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর এক খুনি বিদেশে মারা গেছে বলে তথ্য মিলেছে।
জিয়াউর রহমানকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা প্রমাণ করতে হবে
বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ১৯৭১ সালে ভারতে যাওয়া, আর জেড ফোর্স নামে একটি বাহিনীর প্রধান হওয়া ছাড়া তার কর্মকাণ্ডে আইনমন্ত্রীর কখনও মনে হয়নি তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করেছেন। বলেন, ‘সে কারণে তাকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বলা সঠিক হবে কি না, সেটা মনে হয় বিতর্কযোগ্য।’