জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার সঙ্গে জড়িত পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় খুব শিগগিরই কার্যকর করা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
শনিবার বিকেলে রাজধানীর মিরপুর বাংলা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগ আয়োজিত জাতীয় শোক দিবস ও একুশে আগস্টের শহীদদের স্মরণে দোয়া মাহফিল ও খাদ্য বিতরণ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যার সঙ্গে জড়িত অনেকের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে। বাকি কয়েকজনের ফাঁসির রায় কার্যকর হবে অচিরেই। এ বিষয়ে কাজ চলছে। সরকার এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য ১৯ বার চেষ্ঠা চালানো হয়েছিল। অপতৎপরতাকারীরা এতে সফল হয়নি। সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা দূর করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে চলছে।
তিনি বলেন, ‘করোনা মহামারির সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডাকে সাড়া দিয়ে দলীয় নেতাকর্মীরা জীবন বাজি রেখে জনগণের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের মহাসড়কে রয়েছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার ঘটনায় ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ওই বাড়ির রিসেপশনিস্ট কাম রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা করেন।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির সে সময়কার সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাহহার আকন্দ তিন মাসের বেশি সময় ধরে তদন্ত করেন। এরপর ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ১৯ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্তে সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদসহ চারজনের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে অভিযোগ আসে। কিন্তু বিচার শুরুর আগেই তারা মারা যাওয়ায় অভিযোগপত্রে তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
৭৪ জনকে সাক্ষী করে মামলার তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়। এ ছাড়া ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া খুনি ফারুক-রশিদ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করে ১৯৭৬ সালে টেলিভিশন সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ধারণ করা সেই সাক্ষাৎকারের ভিডিওসহ ৪৬ ধরনের আলামত অভিযোগপত্রের সঙ্গে আদালতে দাখিল করা হয়।
বিচারিক আদালতের রায়
এই মামলার বিচারে ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। মোট ২০২ কার্যদিবস শুনানি হয়। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর রায় দেয় বিচারিক আদালত। তৎকালীন ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল আলোচিত এই হত্যা মামলার প্রথম রায় ঘোষণা করেন। ১৭১ পৃষ্ঠার বিশাল রায়ে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন বিচারক।
হাইকোর্টে যা ঘটেছিল
বিচারিক আদালতের রায়ের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) এবং আসামিদের করা আপিল শুনানির জন্য মামলাটি চলে আসে হাইকোর্টে। সে সময়ে হাইকোর্টে ঘটে নাটকীয় ঘটনা। এ মামলার শুনানি করতে তখন একে একে হাইকোর্টের ৯টি বেঞ্চ বিব্রত বোধ করেছিল। অবশেষে বিচারপতি রুহুল আমিন ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের বেঞ্চে মামলাটি শুনানি হয়।
২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর দ্বিধাবিভক্ত রায় হয়। রায়ে জ্যেষ্ঠ বিচারক ১৫ জনের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন, অন্যদিকে কনিষ্ঠ বিচারক ১৫ জনেরই মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। দ্বিধাবিভক্ত রায়ের ফলে নিয়ম অনুযায়ী মামলাটি চলে যায় তৃতীয় আরেকটি বেঞ্চে। তৃতীয় বেঞ্চের বিচারক ছিলেন বিচারপতি ফজলুল করিম। এই বিচারক অবশেষে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন এবং ৩ জনকে খালাস দেন।
মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১২ আসামি হলেন সাবেক মেজর বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) ফারুক রহমান, কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, এ কে এম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আব্দুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, মেজর (অব.) নূর চৌধুরী, রিসালদার মোসলেমউদ্দিন খান, লে. কর্নেল (অব.) রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুল মাজেদ ও লে. কর্নেল আজিজ পাশা (অব.)।
আপিল বিভাগে চূড়ান্ত রায়
হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করেন আটককৃত আসামিরা।
এর মধ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটে। ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ২০০১ সালের পর থেকে আর এগোয়নি বিচারকাজ।
ছয় বছর আবার পরিবর্তন হয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলাটি সর্বোচ্চ আদালতের দৃষ্টিতে আনেন বর্তমান আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের তিন সদস্যের আপিল বেঞ্চ ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার সুযোগ দিয়ে তাদের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।
দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ ৫ আসামির আপিল খারিজ করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন। ফলে আপিল বিভাগের ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে আর কোনো বাধা থাকে না।
মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে যাদের
সর্বোচ্চ আদালতের চূড়ান্ত রায়ের পর খুনিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি এ কে বজলুল হুদা, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, এ কে এম মহিউদ্দিন ও মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
বজলুল হুদাকে থাইল্যান্ড ও মহিউদ্দিন আহমেদকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা হয়।
গত বছরের ১২ এপ্রিল ভারতে পলাতক থেকে ফেরত আসা আসামি আবদুল মাজেদকে গ্রেপ্তার করে ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এ ছাড়া পলাতক অবস্থায় খুনিদের একজন আবদুল আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা গেছেন বলে জানা যায়।
এখনও পলাতক রয়েছেন পাঁচ আসামি। তারা হলেন আব্দুর রশীদ, শরীফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন, রাশেদ চৌধুরী ও এ বি এম এইচ নূর চৌধুরী।
আলোচিত এ মামলায় বিচারিক আদালতে প্রধান স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটরের দায়িত্বে ছিলেন বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বাবা মো. সিরাজুল হক। তার প্যানেলে আরও ছিলেন আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান, আনিসুল হক ও মোশারফ হোসেন কাজল।