বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সেই ইউএনওকে কি বাঁচাতে চাইছে প্রশাসন?

  •    
  • ৩০ মে, ২০২১ ২৩:২৯

নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে খাদ্য-সহায়তা চাওয়ায় বিপাকে পড়া ব্যবসায়ীকে ইউএনওর ত্রাণ বিতরণে বাধ্য করার ঘটনা তদন্তে গঠন করা কমিটি নির্ধারিত তিন দিনে তো বটেই, এর পরের চার দিনেও ঘটনাসংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গেই কথা বলেনি। প্রশ্ন উঠেছে, তারা আসলে কিছু না করে সময়ক্ষেপণ করতে চাইছে।

নারায়ণগঞ্জে করোনার কারণে বিপাকে পড়া ব্যবসায়ী সহায়তা চাওয়ার পর তাকে ত্রাণ বিতরণে বাধ্য করার ঘটনাটি তদন্তে কমিটি আদৌ কিছু করছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। সেটি দিতে ব্যর্থ হওয়ার পর তারা আরও সাত দিন সময় চেয়েছে। এরপর চলে গেলে আরও চার দিন।

কিন্তু এই সময়ে সেই ব্যবসায়ী ফরিদ আহমেদ, তিনি যার কাছে অলংকার বন্ধক রেখে টাকা এনেছেন, সেই স্বর্ণকার, যিনি ফরিদের হাতে টাকা তুলে দিয়েছেন, সেই স্থানীয় পঞ্চায়েত নেতা বা ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিক কারও সঙ্গেই কথা বলেননি তদন্ত কমিটির সদস্যরা।

দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকলেও কমিটির দাবি তাদের কাজ চলছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা না বলে কীভাবে তদন্ত চলছে- এমন প্রশ্ন করলে কমিটির প্রধান বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।

নারায়ণগঞ্জে নাগরিক সংগঠনের একজন নেতা প্রশ্ন তুলেছেন, প্রশাসন আদৌ এ ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করতে চায়, নাকি তারা সময়ক্ষেপণ করে বিষয়টি ভুলিয়ে দিতে চায়।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা জুয়েল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফরিদ আহমেদের ঘটনা পরিষ্কার এবং মানুষ তা জানে। যদি ইউএনও ভুল না করতেন, তাহলে ফরিদকে কেন টাকা দেয়া হলো?’

এ ঘটনা তদন্তে ১০ দিন সময় কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটি কোথাও না গিয়ে কী তদন্ত করছে?’

এ ঘটনার পুরো দায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরার বলে মনে করেন তিনি। বলেন, ‘ফরিদ আহমেদকে অপমান করা হয়েছে, হেনস্তা করা হয়েছে। আমরা ওই ইউএনওর শাস্তি চাই।’

তদন্ত কমিটি গঠন

গত ২২ মে ফরিদ আহমেদ ত্রাণ বিতরণে বাধ্য হওয়ার পর সেই রাতেই বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় হয়।

পরদিন সকালেই ঘটনাটি তদন্তে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠনের কথা জানান জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ।

কমিটির প্রধান করা হয় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম বেপারীকে। অন্য দুই সদস্য হলেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা রেজাউল করিম ও সহকারী কমিশনার কামরুল হাসান মারুফ।

গত ২০ মে ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য চাওয়ার দুই দিন পর নিজেই ত্রাণ বিতরণে বাধ্য হন বিপাকে পড়া ব্যবসায়ী ফরিদ আহমেদ

কমিটিকে তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু তারা তা না দিয়ে ২৬ মে আরও সাত দিন সময় চেয়ে আবেদন করেন। ২৭ মে সে আবেদন গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক।

তবে সময় বাড়ানোর পর ওই ঘটনাটির তদন্ত কেন তিন দিনে শেষ করা যায়নি, সেই প্রশ্নের জবাব দেয়নি প্রশাসন।

তদন্ত কমিটির তৎপরতা নেই

ঘটনার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত, তাদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছে নিউজবাংলা। জানতে পেরেছে তাদের কারও সঙ্গে গত সাত দিনে কোনো কথাই বলেননি তদন্ত কমিটির কোনো সদস্য।

ত্রাণ দিতে টাকা জোগাড় করতে ফরিদ আহমেদের স্ত্রী অলংকার বন্ধক রেখে সুদের টাকা নেয়া হয় কালীরবাজারের অসিত স্বর্ণ শিল্পালয় থেকে।

দোকানের মালিক পিন্টু লাল ভৌমিকের সঙ্গে কথা হয়েছে নিউজবাংলার। তিনি জানান, ফরিদ আহমেদের স্ত্রী গত ২১ মে স্বর্ণ বন্ধক রেখে ৪৫ হাজার টাকা নিয়েছিলেন। ২৪ মে টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাদের কাহিনি জেনে তিনি কোনো বাড়তি টাকা রাখেননি।

প্রশাসনের কেউ ঘটনাটি জানতে চেয়েছেন কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এ পর্যন্ত প্রশাসনের কেউ আমার দোকানে আসেনি। ফোনও করেনি।‘

ত্রাণ বিতরণের জন্য চাল কেনা হয়েছিল শহরের নিতাইগঞ্জের আজিজ রাইস এজেন্সি থেকে।

ফরিদের কাহিনি প্রকাশ হলে পরদিন প্রশাসনের কর্মকর্তারা তার বাসায় গিয়ে সব জেনে আসেন। বিকেলেই তাকে টাকা ফিরিয়ে দেয়া হয়

তদন্ত কমিটি কথা বলেছে কি না- এমন প্রশ্নে এই আড়তের মালিক আমানুউল্লাহ বলেন, ‘না। আমার সঙ্গে আপনিই প্রথম যোগাযোগ করলেন।’

ফরিদ আহমেদ জানালেন, তার বাড়িতেও যায়নি তদন্ত কমিটি।

তিনি বলেন, ‘কেউ বাড়িতে আসে নাই। ফোনও করে নাই। আসব কি না তাও জানি না। কারা তদন্ত কমিটি তাও জানি না।’

ফরিদ আহমেদের মেয়ে সুমাইয়া আক্তার বৃষ্টি বলেন, ‘তদন্ত কমিটির লোকজন আজ পর্যন্ত বাসায় আসেনি। তবে সোমবার (২৪ মে) দুপুরের পর তাদের বাসায় আসার কথা ছিল। সামনে আসেন কি না, তাও জানি না আমরা।’

সামনে আসছেন না ইউএনও ও ইউপি সদস্য

ইউএনও ফরিদের বাসায় যাওয়ার পর ঘটনাস্থলে থাকা কাশীপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আইয়ুব আলীর দেখা মিলছে না।

বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। ফরিদ আহমেদ তার কাছ থেকে যে ১০ হাজার টাকা ধার করেছিলেন, সেই টাকাও ফেরত নেননি।

সেই ঘটনার পর থেকে সামনে আসছেন না ইউএনও আরিফা জহুরা

২২ মে পর্যন্ত সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে আসা ইউএনও আরিফা জহুরা পরদিন থেকে গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলছেন। আগে ফোন ধরলেও সেদিনের পর থেকে একবারও ফোন ধরেননি। তার অফিসে গিয়ে ভবনে ঢোকার অনুমতিও পায়নি নিউজবাংলা।

কী বলছে তদন্ত কমিটি

তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) শামীম ব্যাপারী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তদন্তকাজ চলমান রয়েছে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে পারব।’

আপনারা তো ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারও সঙ্গে কথা বলেননি। তাহলে তদন্ত কীভাবে চলছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আপনি তো এভাবে প্রশ্ন করতে পারেন না। আমাদের তদন্ত চলমান রয়েছে।’

কমিটির আরেক সদস্য সহকারী কমিশনার কামরুল হাসান মারুফ বলেন, ‘তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাবে না। তদন্ত শেষে জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন দেয়া হবে।’

যা ঘটেছিল

নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়নের দেওভোগ নাগবাড়ি এলাকার ফরিদ আহমেদ গত ২০ মে খাদ্য-সহায়তা চেয়ে ৩৩৩ নম্বরে কল দেন।

খাবার নিয়ে আসেন উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন, অফিস সহকারী কামরুল ইসলাম। পরে তারা ভবন দেখে ফোন দিলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা আসেন ঘটনাস্থলে। দেন শাস্তির ঘোষণা।

জানান, সরকার প্রতি প্যাকেটে যে পরিমাণ খাবার দেয় দুস্থদের, সেই পরিমাণ খাবারসহ ১০০ প্যাকেট করে বিতরণ করতে হবে।

নির্দেশমতো শনিবার বিকেলে ফরিদ আহমেদ সেই খাবার বিতরণও করেন। আর সেখানে উপস্থিত ছিলেন ইউএনও স্বয়ং।

ঘটনাস্থলে গিয়ে ফরিদের জীবনের কাহিনি জেনেছে নিউজবাংলা। কিন্তু জানেননি ইউএনও।

ফরিদ আহমেদকে টাকা তুলে দেয়ার ঘটনাতেও লুকোচুরি করেছে প্রশাসন। নিজেরা না গিয়ে টাকা দেয়া হয় স্থানীয় পঞ্চায়েত কমিটির এই নেতাকে দিয়ে

ফরিদ থাকেন চারতলা বাড়িতে, গেঞ্জি কারখানাও আছে। এটুকু সত্য। কিন্তু এর পেছনে আরও অনেক কাহিনি আছে।

সেই কারখানা বন্ধ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। পরে সংসার চালাতে সেই ব্যক্তি কাজ নিয়েছেন আরেক কারখানায়, কিন্তু চোখের সমস্যায় সেই কাজও করতে পারেন না। সংসারের আয় নেই। আর তিনি যে বাসায় থাকেন, সেটি তাদের ছয় ভাই-বোনের। নিজের অংশ কমই।

এসব কথা না জেনেই ৩৩৩ নম্বরে ফোন করে খাদ্য চাওয়ায় কেবল বাড়ি দেখে আর কারখানা থাকার খবর শুনে তাকে ১০০ জনকে খাবার বিতরণে বাধ্য করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফা জহুরা।

সেদিন নিউজবাংলা প্রকাশ করে ‘ত্রাণ সত্যিই দরকার ছিল ফরিদের, ভুল ইউএনওর’ শিরোনামে সংবাদ।

তোলপাড় হলে পরদিন ফরিদ আহমেদের বাড়িতে একে একে বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন গিয়ে তার জীবনের কাহিনি শুনে আসেন। সেদিন বিকেলের দিকে চুপি চুপি ফরিদকে টাকা ফেরত দেয়া হয়।

এই টাকা ফরিদের হাতে তুলে দিয়েছেন দেওভোগ নাগবাড়ি পঞ্চায়েত কমিটির উপদেষ্টা সাহিনুর আলম।

গণমাধ্যমের কাছে তিনি দাবি করেছেন, এই টাকা তিনি নিজে দিয়েছেন। তবে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ নিশ্চিত করেছেন, টাকা দেয়া হয়েছে প্রশাসনের তহবিল থেকে।

এ বিভাগের আরো খবর