ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করার দাবিতে গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে তুমুল আন্দোলনের মুখে যে আইন পাস হয়েছে, সেটি হেফাজত নেতা মামুনুল হকের জন্য তৈরি করেছে ঝুঁকি।
আগের আইনে ধর্ষণের অপরাধের ধরন বিবেচনায় সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন অথবা মৃত্যুদণ্ড থাকলেও, সংশোধিত আইনে আদালতে প্রমাণ সাপেক্ষে এখন যেকোনো ধর্ষণের ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড যুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, বিয়ের আশ্বাস দিয়ে যৌন সম্পর্কও ধর্ষণ।
মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ঝর্ণা মামলা করেছেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯-এর ১ ধারায়।
এই ধারায় বলা আছে, ‘যদি কোনো পুরুষ বিবাহবন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সী কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করিয়া অথবা ১৬ বছরের কম বয়সী কোনো নারীর সহিত সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে।’
মামলার এজাহারে ঝর্ণা লেখেন, ‘সে (মামুনুল) আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আমার সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে। গত দুই বছর যাবৎ আমাকে বিভিন্ন সময় ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় ঘোরাঘুরির নাম করে নিয়ে গিয়ে তার পরিচিত বিভিন্ন হোটেল ও রিসোর্টে রাত্রিযাপন ও বিবাহের আশ্বাস দিয়ে তার যৌন লালসা চরিতার্থ করে। একপর্যায়ে আমি বিবাহের কথা বললে সে আমাকে বিবাহ করব, করছি বলে নানা অজুহাতে কালক্ষেপণ করতে থাকে।’
- আরও পড়ুন: মামুনুল বললেন নাম তাইয়্যেবা, নারী বললেন জান্নাত আরা
- আরও পড়ুন: রিসোর্টের নারী নয়, তাইয়্যেবা মামুনুলের প্রকৃত স্ত্রীর নাম
৩ এপ্রিল হেফাজত নেতা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়েই রয়্যাল রিসোর্টে নিয়ে গিয়েছিলেন বলে মামলায় অভিযোগ করেছেন ঝর্ণা।
মামলা করার পর ঝর্ণা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে উনি (মামুনুল) আমার সঙ্গে অন্যায় করেছেন, প্রতারণা করেছেন। আমি রাষ্ট্রের কাছে বিচার চাই। আমার এইটুকুই বলার, আর কিছুই বলার নেই।’
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মামুনুল হক সরলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে ধর্ষণ করেছে। বিভিন্ন অজুহাতে আমাকে অনেক জায়গায় নিয়ে গেছে, সেখানে রাত্রি যাপন করেছে। বিয়ের ব্যাপারে কথা বলার অজুহাতে রয়্যাল রিসোর্টের ৫০১ নম্বর রুমে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। সে আমার সঙ্গে অন্যায় করেছে, প্রতারণা করেছে। আমি রাষ্ট্রের কাছে তার বিচার চাই।’
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছিল, ‘যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’
তবে ২০২০ সালের সংশোধিত আইনের ৯(১) ধারায় সশ্রম কারাদণ্ডের পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ডের শাস্তিও যুক্ত হয়েছে। এখনকার আইনটির ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহা হইলে তিনি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’
- আরও পড়ুন: বাসায় ফেরেননি মামুনুল, সন্তানসহ ‘ঘর ছেড়েছেন’ স্ত্রী
- আরও পড়ুন: মামুনুলের শূন্য বাসায় এখনও ফেরেননি তাইয়্যেবা
২০০০ সালের আইনটিতে কেবল ধর্ষণের পর মৃত্যু ও দলগত ধর্ষণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান ছিল। তবে গত বছর সংশোধন করা আইনের ৯(১), ৯(২), ৯(৩), ৯ (৪) (ক) ধারার সবগুলোতেই মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
আপিল বিভাগের সাবেক বিচারক বিচারপতি নিজামুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইন সংশোধনের পর আদালতে অভিযোগ প্রমাণ হলে সে অনুযায়ীই আসামির সর্বোচ্চ সাজা হতে পারে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যে ধারায় মামলা দায়ের হয়েছে, তাতে তো সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবনের বিধান রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এখন সমস্যা হলো ধর্ষণ মামলা প্রমাণ করা। প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের কথা বলা হয়েছে, প্রশ্ন হলো ২৫ থেকে ৩০ বছরের একজন নারীকে প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ কতটা যৌক্তিক। এ অবস্থায় অভিযোগটি প্রমাণ করা বড় চ্যালেঞ্জ হবে।’
ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করার দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি। ফাইল ছবিসাজা বৃদ্ধি যেভাবে
গত বছরের সেপ্টেম্বরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও তার ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর তুমুল আন্দোলনের মুখে সাজা বাড়ানো হয়।
বিক্ষোভকারীরা সব ধরনের ধর্ষণের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করার দাবি তোলেন, এরপর ১২ অক্টোবর মন্ত্রিসভা সেই দাবিতে সায় দিয়ে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়।
সে সময় সংসদ অধিবেশনে না থাকায় ১৩ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের অধ্যাদেশ জারির মধ্য দিয়ে সব ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড যুক্ত হয়।
পরে সংসদ অধিবেশনে বসলে ১৭ নভেম্বর আইন সংশোধনের বিল পাস হয়।
৮ নভেম্বর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক আইন সংশোধন করে যে বিল উত্থাপন করেন, তাতে ৯(১) উপধারায় ‘যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলোর পরিবর্তে ‘মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপন করা হয়।
মামুনুল হকের বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করার পর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ থানা প্রাঙ্গণে জান্নাত আরা ঝর্ণা। ছবি: নিউজবাংলামামলার পর যা হলো
সোনারগাঁ মডেল থানায় মামলার কিছুক্ষণ পর নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ঝর্ণার শারীরিক পরীক্ষা করা হয়।
এরপর সঙ্গে থাকা বড় ছেলে আবদুর রহমান জামির জিম্মায় দেয়া হয় ঝর্ণাকে।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম জানান, ধর্ষণের মামলায় মামুনুল হককে গ্রেপ্তার দেখিয়ে নারায়ণগঞ্জে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মামলার পরবর্তী কার্যক্রম আদালতের মাধ্যমে চলবে।
- আরও পড়ুন:নাম তাইয়্যেবা বলেছিলাম ভয়ে: মামুনুল
- আরও পড়ুন: কোন ফোনালাপে প্রমাণ ঝর্ণা স্ত্রী নন, প্রশ্ন মামুনুলের
গত ১৮ এপ্রিল মামুনুল গ্রেপ্তার হন নাশকতার এক মামলায়। ১৯ এপ্রিল এক মামলায় সাত দিনের রিমান্ড শেষে আরও একটি মামলায় তাকে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে নাশকতার ১৭টিরও বেশি মামলা রয়েছে।
রিসোর্ট-কাণ্ডে মামুনুল যেভাবে বিপাকে
গত ৩ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টের সঙ্গীনিকে দুই বছর আগে বিয়ে করার দাবি করেছিলেন হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম মহাসচিব।
তবে সেই রাতেই তার এই বিয়ের দাবি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ, তিনি তার স্ত্রী আমিনা তাইয়্যেবাকে ফোন করে নিজে বলেন, তার সঙ্গীনি জনৈক শহিদুল ইসলামের স্ত্রী।
আর মামুনুল হক রিসোর্টেও সঙ্গীনির নাম গোপন করেন। তিনি রেজিস্টার বইয়ে তার নাম লেখেন আমিনা তাইয়্যেবা। এটি প্রকৃতপক্ষে তার স্ত্রীর নাম।
আবার স্থানীয়দের জিজ্ঞাসাবাদে শ্বশুরের নাম বলেন জাহিদুল ইসলাম, গ্রামের বাড়ি খুলনায় বলে দাবি করেন। পরে জানা যায়, ঝর্ণার বাবার নাম ওলিয়র রহমান, বাড়ি ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়।
রিসোর্ট-কাণ্ডের পর চাপে পড়তে থাকেন মামুনুল হক। গত ১৮ এপ্রিল তাকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ছবি: নিউজবাংলাযদিও ওই রাতেই চার ভাইকে নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে তিনি দাবি করেন, দুই বছর আগে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে তাদের।
তবে রিসোর্টে হাঙ্গামার দিনই মামুনুলের স্ত্রী আমিনা তাইয়্যেবা তার চার সন্তানকে নিয়ে মামুনুলের বাসা ছেড়ে চলে যান।
তবে মামুনুল তার বিয়ে করার দাবি করতেই থাকেন। যদিও ১৮ অক্টোবর গ্রেপ্তার হওয়ার পর পুলিশকে ‘চুক্তিভিত্তিক’ বিয়ের কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার হারুন অর রশিদ।
- আরও পড়ুন: মামুনুলের ‘চুক্তিভিত্তিক বিয়েতে’ তিন শর্ত
- আরও পড়ুন: মামুনুলের কথিত তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে যা জানা গেল
এর মধ্যে আরও এক নারীর সঙ্গে মামুনুলের গোপন সম্পর্কের কথা ফাঁস হয়। সেই নারীর ভাইকেও মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসায় ডেকে নিয়ে মামুনুল দাবি করেছেন, তিনি আরও একটি বিয়ে করেছেন গোপনে।
রিসোর্ট-কাণ্ডের পর থেকে ঝর্ণার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। তাকে উদ্ধারের অনুরোধ করে বড় সন্তান আবদুর রহমান জামি ঢাকার পল্টন থানায় ও বাবা ওলিয়র রহমান কলাবাগান থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।
২৭ এপ্রিল মোহাম্মদপুরে মামুনুল হকের বোনের বাসা থেকে ঝর্ণাকে উদ্ধার করে তার বাবার হাতে তুলে দেয় পুলিশ। দুই দিন পর সোনারগাঁ থানায় গিয়ে ঝর্ণা মামলা করেন।