বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আঁতকে উঠছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী

  •    
  • ২৯ মার্চ, ২০২১ ২২:৩৯

‘কী করছে দেখছনি? পুইড়া তারার লাভ হইলো কী? সবগুলা জানোয়ার। নিজের ঘরের জিনিস কি কেউ নিজে ভাঙে? এইডি তো আমরার জিনিসই।’

শুক্র ও রোববার হেফাজত কর্মীদের হামলার ব্যাপকতা সোমবার পরিস্থিতি খানিকটা শান্ত হওয়ার পর নিজের চোখে দেখতে পেরেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী। সংঘর্ষ সহিংসতার মধ্যে ঘরে বসে তারা হামলার কথা গণমাধ্যমে জেনেছে, কিন্তু সেটি যে এত ভয়াবহ ছিল, সেটা এখন বুঝতে পেরেছে তারা।

অটো চালক রাব্বি মিয়াকে বিকালে পাওয়া যায় শহরের কুমারশীল এলাকায়। আগের দিন এখানকার ভূমি অফিস আর সুর সম্রাট আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনে ভাঙচুর করে আগুন দেয় মাদ্রাসা ছাত্ররা।

সঙ্গীতাঙ্গনের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, ‘কী করছে দেখছনি? পুইড়া তারার লাভ হইলো কী? সবগুলা জানোয়ার। নিজের ঘরের জিনিস কি কেউ নিজে ভাঙে? এইডি তো আমরার জিনিসই।’

ভাষা সংগ্রামী শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মরণে শহরের কেন্দ্রস্থলে করা ভাষা চত্বরে হামলার কী কারণ থাকতে পারে, সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না মুদি দোকানি আফজাল করিম।

এই চত্বরের পাশে তার দোকানেও ভাঙচুর চালানো হয়েছে। তবে নিজের ক্ষতির চেয়ে বিশেষ করে পাশের ভূমি অফিসে ধ্বংসলীলা দেখে তিনি আফসোস করছেন।

আফজাল বলেন, ‘আমার দোহানের সাটার আর কারেন্টের মিটার ভাঙছে। তেও আমার বিষয়টা ছুডু। কিন্তু ভূমি অফিসো আগুন দিয়া তারা ক্ষতিডা করছে, এইডা পুষাইতে আমারার কয়েক বছর সময় লাইগ্যা যাইব। যারার জমিজমা লইয়া ঝামেলা আছে, হেরার অনেক সমস্যা অইব।’

শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ ভাষা চত্বরে হামলার পরদিন পুড়ে যাওয়া স্থাপনাগুলো ধ্বংসযজ্ঞের প্রতীক হয়ে রয়েছে

ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে হেফাজত সমর্থকদের প্রথম হামলা হয় শুক্রবার। সেদিন রেলস্টেশন, মৎস্য অধিদপ্তর, আনসার ক্যাম্পে আগুন দেয়া হয়। আর পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে হামলায় পুলিশ গুলি চালালে নিহত হয় একজন।

এর প্রতিক্রিয়ায় রোববারের হরতালে হেফাজত কর্মীরা ছিল আরও সহিংস। সেখানে জেলা পরিষদ কার্যালয়, পৌরসভা কার্যালয়, সুর সম্রাট আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ছাড়াও তাণ্ডব চালানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির সবগুলো স্থাপনায়।

হামলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধুর দুটি ম্যুরাল ভাঙচুরের পাশাপাশি দেয়া হয়েছে আগুন, ভাঙচুর চালানো হয়েছে শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিফলকে, হামলা হয়েছে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার কার্যালয়ে, শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরেও ধরানো হয়েছে আগুন।

রোববার বিকালে মাইকিং করে শহর ছেড়ে মাদ্রাসায় ফিরে যাওয়ার পর সোমবার সকালেও রাস্তায় চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল অফিস-আদালতের ফাইল, জরুরি কাগজপত্র, রিকশার টায়ার, বিভিন্ন দোকান থেকে টেনে এনে পুড়িয়ে দেয়া ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী।

রোববার মাদ্রসার কর্মীরা সরকারি-বেসরকারি স্থাপনা বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের নানা স্মৃতিচিহ্নে হামলা করেছে নির্বিচারে

ব্রাহ্মণবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নিউজবাংলার সঙ্গে আলাপকালে ভয়ে নিজের নামও প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘হেফাজতের এই ঘটনায় মানুষদের মধ্যে এখন আতঙ্ক বিরাজ করছে যা কাটিয়ে উঠতে অনেকটাই সময় লাগবে। এই ব্রাহ্মণবাড়িয়া আগের মতো হতে গেলে অনেকটা সময় লেগে যাবে।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক আবদুন নুর বলেন, ‘আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন ও মিলনায়তনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অনেক সম্পদ রয়েছে যা অন্যত্র পাওয়া অনেকটাই দায় হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে শহিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্ত্বরে তারা অগ্নিসংযোগ করেছে। এই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাম ছড়িয়ে রয়েছে গোটা বাংলাদেশে।’

তিনি বলেন, ‘আজকের তাদের এই হামলার ঘটনা জনসাধারণের মনে অনেকটাই আতঙ্ক তৈরি করে দিয়েছে। এই আতঙ্ক দূর করতে অনেক সময় লেগে যাবে। আর শহরের ক্ষতগুলো চিরস্থায়ী হয়ে রয়ে যাবে।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ বলেন, ‘মানুষের সরকার অথবা দলীয় সিদ্ধান্তের ব্যাপারে দ্বিমত থাকতে পারে। আর সেই দ্বিমত জানানো উচিত খুবই নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে।

মৎস্য অধিদপ্তর কার্যালয়ে ভাঙচুর করে পেট্রল ঢেলে আগুন দেয়ার পর পুড়ে যায় বেশ কয়েকটি মোটর সাইকেল

‘আমি আমার জীবনে প্রতিবাদ অনেক দেখেছি, কিন্তু গত শুক্র ও রোববার যে তাণ্ডব চালানো হয়েছে এটা নজিরবিহীন। এই ধ্বংসযজ্ঞের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কঠোর শাস্তি হওয়া দরকার। কেবল হামলাকারী নয়, তাদের যারা ইন্দনদাতা তাদেরকেও খুঁজে বের বিচারের আওতায় আনতে হবে।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

শুক্রবার যখন এসপি কার্যালয়ে হামলা হয় তখন পুলিশ গুলি করে। শনিবার হেফাজত কর্মীরা সুহিলপুরের নন্দনপুরে মহাসড়ক অবরোধ করে পুলিশের ওপর হামলা চালালে গুলি ছুড়ে পুলিশ। আর রোববারের হরতালে তারা গুলি চালায় পুলিশ লাইনস এলাকায় আক্রান্ত হওয়ার পর।

এর বাইরে কোনো স্থাপনায় হামলার সময় পুলিশ বাধা দেয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের পাশাপাশি একই কথা বলেছেন সদর আসনের সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীও।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের চেয়ারম্যান আবু সাঈদ বলেন, ‘আইন শৃঙ্খলাবাহিনী অনেকটাই এই সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল যে তাদের কোন দিকে আগানো উচিত। সরকারের যদি কোনো ইঙ্গিত না থাকে তাহলে আমি বলব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এটি সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারেনি।’

বিকালে সদর আসনের সংসদ সদস্য মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তাণ্ডবের সময় কারা হামলা করল, কেন হামলা করল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জেলা প্রশাসন কেন নিষ্ক্রিয় থেকে নীরব ভূমিকা পালন করল, কেন সদর থানা থেকে এমন মাইকিং করা হলো তার একটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। আমরা সমগ্র বিষয়টি উপরে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছি।’

রোববার সকালে যখন মাদ্রাসার ছাত্ররা মিছিল নিয়ে আসে, তখন সদর থানা থেকে মাইকিং করে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রহিম বলেন, ‘আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করুন, আমরা আপনাদেরকে কোনো বাধা দেব না।’

সোমবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সফরে এসে পুলিশের বিরুদ্ধে উঠা নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপ মহপরিদর্শক-ডিআইজি আনোয়ার হোসেনও।

তিনি অবশ্য অভিযোগ স্বীকার করতে চাননি। বলেন, ‘ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের সময় পুলিশ নীরব ছিল না। সাধ্যমত চেষ্টা করেছে পুলিশ। যতটুকু পেরেছে পুলিশ করেছে। বাইরে থেকে অতিরিক্ত পুলিশ এনে সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। তবু এ ব্যাপারে অতিরিক্ত ডিআইজিকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে।’

তিন দিনে ১১ জনের প্রাণহানি

পুলিশ আক্রান্ত হওয়ার পর যেখানে যেখানে গুলি করেছে, তার প্রতিটিতে প্রাণহানি হয়েছে। তিন দিনে মৃত্যু হয়েছে মোট ১১ জনের।

শুক্রবার এসপি অফিসে হামলার পর গুলিতে নিহত হন পৌর এলাকার দাতিয়ারার বাসিন্দা আশিক।

সোমবার পুড়িয়ে দেয়া সুর সম্রাট আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন পরিদর্শন করেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন

শনিবার শহরের নন্দনপুর এলাকায় হামলার পর পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছয় জন। এরা হলেন আল আমিন, জুরু আলম, বাদল মিয়া, সুজন মিয়া, কাউসার মিয়া ও হোসেন মিয়া।

রোববার হরতালে পুলিশ লাইনসে হেফাজত কর্মীদের হামলার সময় পুলিশ গুলি চালালে নিহত হন চার জন। তাদের তিন জনের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন নুরুল আমিন, কালন মিয়া ও মোহাম্মদ জোবায়ের।

এ বিভাগের আরো খবর