চিকিৎসককে বিয়ে করে অপহরণ মামলার আসামি হওয়া নাপিত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কারাগারে বন্দি।
যদিও তদন্ত সংস্থা সিআইডি সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিল, অপহরণের ঘটনা ঘটেনি, দুজন ভালোবেসে বিয়ে করেছেন, তার পরেও বিচারক তাকে কারাগরে পাঠিয়েছেন।
সম্প্রতি এই দম্পতিকে উদ্ধার করে গণমাধ্যমের সামনে আনার ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মধ্যেই এই আদেশ এসেছে রংপুরের একটি আদালত থেকে। ওই চিকিৎসক প্রশ্ন তুলেছেন, কেন তাকে স্বামীছাড়া থাকতে হবে। তিনি নিজেও আদালতে গিয়ে বলেছেন, তিনি অপহৃত হননি।
একটি অনলাইনভিত্তিক গণমাধ্যমকে ওই নারী বলেন, ‘আমি জানি না কোর্ট কেন তাকে আটক করে দিল। আমি তো কোর্টে সাক্ষ্য দিয়েছি, সব বলেছি; তারপরও ওকে কেন আটক করল, আমি জানি না।’
গত ২৩ ডিসেম্বর রংপুর সিআইডি কার্যালয়ে পুলিশ ওই দম্পতি ও তাদের সন্তানকে সাংবাদিকদের সামনে উপস্থাপন করে। পুলিশের বক্তব্য ছিল, নাপিত প্রেমিককে নিয়ে পালিয়ে বিয়ে করার ২১ মাস পর সন্তানসহ ওই গাইনি চিকিৎসককে উদ্ধার করেছেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে নারী চিকিৎসক স্পষ্টতই বলেন, তিনি নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করে সুখী আছেন। তাকে কেউ অপহরণ করেনি।
এরপর দুই জনকে আদালতে তোলে পুলিশ। বিচারক নারী চিকিৎসককে জামিন দিলেও আটকে দেন তার স্বামীকে।
ওই চিকিৎসকের এটি দ্বিতীয় বিয়ে। আগের স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর সম্পর্ক তৈরি হয় আরেক জনের সঙ্গে। পরিবারের অমতে বিয়ে করে চলে আসেন ঢাকায়। রোগী দেখে চালান সংসার। একটি সন্তানও হয়েছে। আগের সংসারের সন্তানকেও দেখাশোনা করেন তিনি।
চিকিৎসকের সন্ধান না পাওয়ার পর তার বাবা ২০১৯ সালের ২৭ মার্চ রংপুরের কোতয়ালি থানায় অপহরণ মামলা করেন। আসামি করা হয় ওই নারীর বর্তমান স্বামীকে।
থানা পুলিশ ব্যর্থ হওয়ার পর তদন্তের ভার পায় সিআইডি। তারা ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি বাড়িতে দম্পতির অবস্থানের কথা জানতে পারে। সেখান থেকে ধরে নিয়ে রংপুর সিআাইডি কার্যালয়ে হাজির করা হয় দুই জনকে। সাংবাদিক ডেকে ছবিও তোলা হয়।
এরপর তাদেরকে হাজির করা হয় রংপুর মহানগর হাকিম দেলোয়ার হোসেনের আদালতে।
আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা আতিউর রহমান বলেন, ‘চিকিৎসকের বাবার করা অপহরণ মামলায় তাকে (স্বামী) আদালত জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মেয়ে (নারী চিকিৎসক) যেহেতু সাবালক, সেহেতু তাকে নিজ জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছেন (বিচারক)। আগের সংসারের বাচ্চাকেও মায়ের জিম্মায় দিয়েছেন। তবে তার বাবা যখন ইচ্ছা করে দেখা করতে পারবেন।’
তাহলে কেন স্বামীকে আটকে দেয়া হলো, এমন প্রশ্নে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সেটা আদালতের এখতিয়ার, আমি বলতে পারব না।’
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির উপপরিদর্শক ইউনুস আলী বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন অনুসন্ধান করি। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোহাম্মদপুরের চানমিয়া হাউজিং থেকে (দম্পতিকে) গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসি। যেহেতু তাদের বিরুদ্ধে মামলা ছিল, আদালতে হস্তান্তর করি।’
‘কিন্তু চিকিৎসক তো বললেন তিনি অপহৃত হননি’- এমন প্রশ্নে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘সেটা আদালতের বিষয়।’
চিকিৎসকের বাবার করা অপহরণ মামলায় রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি সেই যুবকশিগগির তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেয়া হবে বলেও জানান এই সিআইডি কর্মকর্তা।
অপহরণ যে হয়নি, সেটা নিশ্চিত করেছেন রংপুর সিআইডির পুলিশ সুপার মিলু মিয়া বিশ্বাসও। গত ২৬ ডিসেম্বর নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘সিআইডি অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে যে, বাদীর মেয়ে অপহৃত হননি বরং তিনি নিজের ইচ্ছায় ঢাকায় এসে বিয়ে করেছেন। তাদের একটি সন্তান রয়েছে। তবে মেয়েটির আগে এক বার বিয়ে হয় সেখানেও আট বছরের একটি সন্তান আছে।’
তদন্ত কর্মকর্তা ইউনুস আলী জানান, ওই চিকিৎসক যাকে বিয়ে করেছেন, তার নামে কয়েকটি মামলা আছে। তবে তিনি চালান দিয়েছেন এই একটি মামলাতেই।
ওই চিকিৎসক যা বলেছেন, তাতে তদন্তের আর কী বাকি থাকে- এমন প্রশ্নে সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, ‘ডাক্তার ওনার বক্তব্য আদালতে দিয়ে চলে গেছেন। এখন আমরা বাকিটা তদন্ত করে দেখব, এর মধ্যে আর কিছু আছে কিনা। সে বিষয়ে পরবর্তীতে জানানো যাবে।’
এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন
ঘটনাটি নিয়ে কাজ করছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও। কমিশনের উপপরিচালক সুস্মিতা পাইক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এর থেকে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর হতে পারে? একজন নারী কাকে বিয়ে করবেন, সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। আমাদের সংবিধান, মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্র, সমস্ত জায়গাতেই নারীকে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।’
ওই নারীকে সামনে এনে সংবাদ সম্মেলনের তীব্র সমালোচনা করেন মানবাধিকার কমিশনের এই কর্মী। বলেন,‘পাবলিকলি তাকে একটা শিশুসহ এভাবে হেনস্থা করা, এর থেকে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর কী হতে পারে। তার মানবিক মর্যাদায় আঘাত হেনেছে এটা, তার আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে।’
ব্যাখ্যা দিতে হবে রংপুর সিআইডি প্রধানকে
ওই নারী চিকিৎসক ও তার স্বামীকে গণমাধ্যমের সামনে এনে ছবি তোলানো ও তার বিয়ে নিয়ে রংপুর সিআইডির প্রধান মিলু মিয়া বিশ্বাসের আপত্তিকর মন্তব্য ভালো চোখে দেখছে না পুলিশ সদরদপ্তরও।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটি খুবই স্পর্শকাতর একটি ঘটনা, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। রংপুরের ঘটনা একজন পুলিশ কর্মকর্তার ব্যক্তিগত অভিমত।’
তিনি বলেন, ‘এ বিষয়টি আইজিপি মহোদয়কে অবহিত করা হয়েছে। ওই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হবে।’
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘তার (সিআইডি) এই অভিমত সমস্ত পুলিশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা প্রভাব পড়বে। মানুষের মানবিক মর্যাদার জায়গাগুলো নিয়ে এভাবে কথা বলা কোনোভাবেই তার (সিআইডি কর্মকর্তা) কাছ থেকে আশা করা যায় না।’
যা বলেছিলেন রংপুর সিআইডির প্রধান
এই ঘটনাটি নিয়ে গত ৩০ ডিসেম্বর রংপুর সিআইডির এসপি মিলু মিয়া বিশ্বাসের সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। তার মতে, নাপিতকে বিয়ে করা ডাক্তারের উচিত হয়নি। এটা নৈতিক অপরাধ হয়েছে।
কীভাবে নৈতিক অপরাধ হয়েছে, তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘তার আগে একটা বাচ্চা ছিল; সাত-আট বছর বয়স। সেই বাচ্চাসহ তিনি চলে গেছেন। আরেকজনের বাচ্চা নিয়ে গেছেন। যদি আপনার বাচ্চা নিয়ে যেতেন তবে আপনি কি অপহরণ মামলা দিতেন না? আপনি যখন মামলা দেবেন, তখন আমার দায়িত্ব বাচ্চা খুঁজে বের করার। সেই বাচ্চার বৈধ মালিক তো মা না, আগের ওই স্বামী।’
সিআইডি কর্মকর্তা এই দাবি করলেও দেখা যায়, ওই নারী চিকিৎসকের আগের স্বামী মামলা করেননি, তার সন্তানকে কাছে রাখার দাবি করে আদালতেও যাননি।
এরপর সিআইডি কর্মকর্তা টানেন নারী চিকিৎসকের স্বামীর পেশাগত পরিচয়ের প্রসঙ্গ। তার দাবি, একজন নাপিতের সঙ্গে একজন চিকিৎসকের বিয়ে হওয়া উচিত না।
তিনি বলেন, ‘তিনি (নারী চিকিৎসক) একে তো আইনগত অপরাধ করেছেন (যদিও কোন আইনে অপরাধ তার ব্যাখ্যা দিতে পারেননি তিনি)। তারপর নৈতিক অপরাধ করেছেন। তিনি একজন ডাক্তার। তিনি যার সঙ্গে চলে গিয়েছেন, তার সঙ্গে তার যাওয়া মানায় না।
‘তিনি ডাক্তার সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। একজনের আট বছরের বাচ্চাকে নিয়ে ভেগে গেছেন। সেই বাচ্চার সঙ্গে বাবার কোনো যোগাযোগ করতে দেননি। একদম গায়েব হয়ে গেছেন। এইগুলো তো অপরাধ।
‘এইগুলা নৈতিক অপরাধ। এটা বিচারাধীন বিষয়, তবে তাতে সমস্যা নেই। আমরা মিডিয়ার সঙ্গে কাজ করি। আর আমরা যদি এই তথ্য প্রকাশ না করি তবে সমস্যা হবে। সমাজের তো বোধোদয় হতে হবে। এমন বোধোদয় আমাদের হওয়া উচিত।’
সেই সংবাদ সম্মেলনে সচেতনতা তৈরি হবে দাবি করে সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এই উদাহরণগুলো কেন দেই? যাতে এমন ঘটনা আর না ঘটে। তিনি একজন ডাক্তার। তাকে কি এমন কারও সঙ্গে চলে যেতে হবে? তার কাছে কি আর কোনো রাস্তা ছিল না? আমরা এটা জানান দিতে চেয়েছি।’