পদ্মা সেতুর জন্য মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ার পর নেত্রকোণায় একজনকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার মামলায় পুলিশ কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি। যদিও সে সময় হত্যার ভিডিও প্রকাশ হয়েছিল।
১৪ মাস তদন্তের পর আদালতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা সিআইডি জানিয়েছে, দল বেঁধে পিটিয়ে হত্যা হলেও সাক্ষ্য-প্রমাণ মেলেনি। আসামি করা যায়নি কাউকে।
সেখানে ঘটনা ঘটেছিল দুটি। একটি শিশুর খণ্ডিত মস্তক ব্যাগে বহন করছিলেন এক যুবক। তাকে খুনি ভেবে প্রকাশ্যে পিটিয়ে মেরে ফেলে এলাকাবাসী।
এই ঘটনায় দুটি মামলা হয়। সিআইডি দাবি করেছে, শিশুটির হত্যাকারী গণপিটুনিতে নিহত যুবক। তবে এই যুবককে কারা হত্যা করেছে, তা বের করা যায়নি।
- আরও পড়ুন: আসামি চিহ্নিত, বিচার পায়নি রেনুর স্বজনরা
দল বেঁধে পিটিয়ে হত্যার বিচার বিরল। গত বছর পদ্মাসেতু নিয়ে গুজব ছড়িয়ে যে কয়টি গণপিটুনি ও হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার একটিও বিচার শুরু করা যায়নি।
আসলে গত ১০ বছরে দল বেঁধে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় একটি মামলাতেও রায় আসেনি।
গণপিটুনি নিয়ে গবেষণা করা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজিব নন্দী জানিয়েছেন, তিনি এখন পর্যন্ত কোনো মামলাই পাননি যেটার রায় হয়েছে।
এর মধ্যে গত ২৯ অক্টোবর লালমনিরহাটে মসজিদে তর্কাতর্কির জেরে ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে একজনকে দল বেঁধে পিটিয়ে হত্যার পর মরদেহ পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় মামলা হয়েছে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে। পুলিশ এরই মধ্যে ১০ জনেরও বেশি আসামিকে গ্রেফতার করেছে। দ্রুত বিচারের আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন।
২০১৯ সালে পদ্মাসেতুর জন্য মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে বেশ কয়েকজনকে হত্যার পরও প্রশাসন এই ধরনের আশ্বাস দিয়েছিল।
সে সময় ঢাকার বাড্ডায় একটি ঘটনায় পিটিয়ে হত্যার ভিডিও প্রকাশ হয়। আসামিরা চিহ্নিত হয় সহজেই। তবে দ্রুত বিচারের আশা ছেড়ে দিয়ে এখন ভুক্তভোগী পরিবার বিচার হবে কি না, তা নিয়েই সংশয়ে।
এর আগে কক্সবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরসহ বেশ কিছু হামলার বিচার করা যায়নি।
আরও পড়ুন: ‘বিচার দেইখা মনে হয় মরতে পারমু না’
ওই বছর এই গুজবে প্রথম হত্যার ঘটনাটি ঘটে নেত্রকোণায়।
২০১৯ সালের ১৮ জুলাই বেলা পৌনে একটার দিকে জেলা শহরের নিউটাউন এলাকার অনন্তপুকুরের পশ্চিমপাড়ে ব্যাগে শিশুর কাটা মাথা দেখে এক জনকে পিটিয়ে মেরে ফেলে স্থানীয়রা।
পরে জানা যায় নিহত যুবকের নাম যুবক রবিন মিয়া। তিনি নেত্রকোণা শহরের কাটলী এলাকায় ভাড়া থাকতেন; এলাকায় রিকসা চালাতেন।
রবিনের মৃত্যুর পর তার বাবা একলাস উদ্দিন ওই এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।
২০১৯ সালের ১৮ জুলাই নেত্রকোণায় গণপিটুনিতে হত্যার তদন্ত করে ‘কিছুই পায়নি’ সিআইডি
রবিনের বহন করা ব্যাগে ছিন্ন মস্তকটি ছিল শহরের পূর্ব কাটলী এলাকার রিকশাচালক রইছ উদ্দিনের ছেলে সজীব মিয়ার।
ঘটনার পর নেত্রকোণা মডেল থানায় দুইটি মামলা হয়। সজীব হত্যায় মামলার বাদী হন সজীবের বাবা রইছ উদ্দিন। রবিন হত্যা মামলায় বাদী হন থানার উপপরিদর্শক নাজমুল হাসান।
- আরও পড়ুন: নাসিরনগরে হামলাকারীদের কিছুই হয়নি
পুলিশের বিশেষায়িত তদন্ত সংস্থা সিআইডি গত ২৫ সেপ্টেম্বর নেত্রকোণা জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে এই প্রতিবেদন দেয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা সিআইডির উপ-পরিদর্শক (এসআই) এমদাদুল বাশার।
এমদাদুল জানান, দুইটি মামলাই থানা পুলিশের হাত বদল হয়ে সিআইডিতে আসে। সজীবের বাবার করা হত্যা মামলার তদন্তে রবিনই দায়ী হিসেবে প্রমাণ মিলেছে। শিশুটিকে বলাৎকার করার পর হত্যার তথ্য মিলেছে। আর রবিন যেহেতু নিহত হয়েছে সে কারণে মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।
- আরও পড়ুন: সাঁওতাল পল্লিতে হামলা: বিচারের গতি ধীর
আর নিহত রবিনের হত্যা মামলায় আদালতে দেয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘ঘটনা সত্য। তবে সুনির্দিষ্টভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।’
দুইটি মামলারই চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালত গ্রহণ করেছে বলে জানান এসআই এমদাদুল বাশার।