বহিষ্কৃত আহ্বায়ক হাসান আল মামুনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ-ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের বিরুদ্ধে ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ার দাবি করেছে ‘বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ’।
ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে গঠন করা কমিটির প্রধান নিউজবাংলাকে বলেছেন, তারা এই ঘটনার কোনো ছবি বা ভিডিও পাননি। কেবল অভিযোগের ভিত্তিতে ধর্ষণ হয়েছে ধরে নিতে পারেন না।
একজন সদস্য বলেছেন, এই ঘটনার ‘উপযুক্ত সাক্ষী’ পাননি তারা। আবার ভুক্তভোগী নারীর পরিবার থেকে কেবল মৌখিক অভিযোগ করা হয়েছে, কোনো প্রমাণ দেয়া হয়নি। তাই তারা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন।
- আরও পড়ুন: ‘তবে কি আমার ভিডিও ভাইরাল হতে হবে?’
কমিটি ১৬ দিনের মাথায় প্রতিবেদন জমা দিয়েছে ছাত্র অধিকার পরিষদকে। তবে এখনও তা প্রকাশ করা হয়নি।
পরিষদের যুগ্ন আহ্বায়ক রাশেদ খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করে ব্যবস্থা নেব। যদি প্রমাণ হয় মিথ্যা অভিযোগ ফাঁসানোর জন্য অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেক্ষেত্রে আমরা ব্যবস্থা নেব।’
ধর্ষণ এবং ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগে মামলার প্রতিবাদে গত ২১ সেপ্টেম্বর নুরুল ইসলাম নুরের নেতৃত্বে ঢাকায় বিক্ষোভ করে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদ। ফাইল ফটো।
ভুক্তভোগী নারী বলেছেন, কমিটি কী তদন্ত করবে, সেটা তার আগেই বোঝা হয়ে গেছে। তাই তিনি কথিত তদন্ত কমিটির সঙ্গে কথাও বলেননি।
২৩ সেপ্টেম্বর হাসান আল মামুনকে ছাত্র অধিকার পরিষদের আহ্বায়কের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি অভিযোগ খতিয়ে দেখতে গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি।
পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, পরিষদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা, কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক তারেক রহমান ও রাফিয়া সুলতানা ঘটনাটি তদন্ত করবেন। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সুপারিশসহ ঘটনার বিস্তারিত তথ্য সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের কাছে জমা দেবেন।
- আরও পড়ুন: বোনটার জন্য তো নামতে দেখলাম না: ছাত্রলীগ
এর মধ্যে বেগমগঞ্জে নারী নির্যাতনের ঘটনায় শুরু হওয়া আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়ে ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ডের দাবি তুলে ধরছে ছাত্র অধিকার পরিষদ।
হাসান আল মামুনের বিরুদ্ধে তদন্তের প্রতিবেদনে কী আছে?-জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি ইয়ামিন মোল্লা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা হাসান আল মামুনের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো প্রমাণ পাইনি। তাই নুরের বিরুদ্ধে ধর্ষণে সহযোগিতার বিষয়টিও আসে না।’
এই সিদ্ধান্তে কীভাবে পৌঁছলেন- এমন প্রশ্নে ইয়ামিন বলেন, ‘আমরা ঘটনার স্থান পর্যবেক্ষণ করেছি। সেখানেও আমরা উপযুক্ত কোনো সাক্ষী পাইনি।’
ঘটনাস্থল পরিদর্শন ছাড়া আর কী করেছেন- জানতে চাইলে ‘তদন্ত কমিটির’ সদস্য বলেন, ‘অভিযোগকারীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ওরা মৌখিকভাবে দাবি করছে, কিন্তু আমাদের কোনো মেডিকেল রিপোর্ট শো করেনি। এ পর্যন্ত তদন্ত করার জন্য কোনো সহযোগিতা আমরা অভিযোগকারীর কাছ থেকে পাইনি।’
ইয়ামিন বলেন, ‘অকাট্য কোনো কিছু আমাদের হাতে আসেনি।’
অকাট্য কী হাতে আসতে পারত?- এমন প্রশ্নে জবাব আসে, ‘হতে পারত কোনো ছবি, ভিডিও এমন কিছু আমরা খুঁজে পাইনি, বা অভিযোগকারী আমাদের দিতে পারেনি। তাছাড়া ধর্ষণ একটি সেনসিটিভ কেস। তাই কারও মৌখিক অভিযোগে আমরা কাউকে অপরাধী বলতে পারি না।’
‘বাদী অনলাইনে যে চ্যাটের কথা বলেছে সেটাও আমরা পাবলিক করেছি। সেখানেও আমরা এ সংক্রান্ত কিছু পাইনি।’
- আরও পড়ুন: ধর্ষণবিরোধী সমাবেশে ৯ দাবি
ইয়ামিন বলেন, ‘বাদী বলেছেন ২৪ সেপ্টেম্বর নীলক্ষেতে নুরের সঙ্গে তার দেখা হয়। আমরা তদন্ত করে দেখেছি, নুরের সঙ্গে সেদিন তার দেখা হয়নি। নুর ২৫ সেপ্টেম্বরের একটি ত্রাণ কার্যক্রমের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন বাসায়।’
বাদী যা বলছেন
মামলার বাদী আসামিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেছেন, ছাত্র অধিকার পরিষদের তদন্তে তার কোনো আস্থা আগে থেকেই নেই।
এই তরুণী বলেন, ‘এরা কী তদন্ত করবে, সেটা আমিও জানি, আপনারাও জানেন। যে অপরাধী,তার লোকেরাই যদি তদন্ত করে, তাহলে আমি তাদের সঙ্গে কথা বলব কেন?’
যা যা ঘটেছে
গত ২০ সেপ্টেম্বর ছাত্র অধিকার পরিষদের সে সময়ের সভাপতি হাসান আল মামুনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে লালবাগ থানায় মামলা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। মামুন এবং বাদী একই বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।
ধর্ষণে সহযোগিতার অভিযোগে আসামি করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসুর সদ্য বিদায়ী ভিপি নুরুল ইসলাম নুরুল ইসলাম নুরুসহ পাঁচ জনকে।
বাকি চার আসামি হলেন ছাত্র অধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নাজমুল হাসান ও সাইফুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি নাজমুল হুদা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ হিল বাকি।
মামলায় বলা হয়, ডিপার্টমেন্টের ‘বড় ভাই’ মামুনের সঙ্গে বাদীর পরিচয় ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
অভিযোগ করা হয়, গত ৩ জানুয়ারি দুপুরে মামুন বাদীকে তার বাসায় (১০৪ মসজিদ রোড, নবাবগঞ্জ) নিয়ে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেন।
এতে অসুস্থ হয়ে পড়লে পরদিন মামুনের বন্ধু সোহাগের মাধ্যমে বাদীকে হাসপাতালে ভর্তি করেন।
মামুন প্রথমে রাজি না হলেও পরে বিয়েতে রাজি হন। কিন্তু পরে সময়ক্ষেপণ করতে থাকেন।
গত ২০ জুন বিষয়টি নুরকে জানালে তিনি মীমাংসার আশ্বাস দেন বলে জানান বাদী। ২৪ জুন নীলক্ষেতে নুর তার সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু তখন তাকে বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। কথা না শুনলে ভক্তদের দিয়ে ফেসবুকে উল্টাপাল্টা পোস্ট করে বাদীকে ‘পতিতা’ বলে প্রচার করার হুমকি দেন।
তবে নুর এই মামলার পেছনে সরকারের ইন্ধন দেখেছেন। তার দাবি, তিনি সরকারের সমালোচনা করায় প্রশাসন এই মামলা করিয়েছে।
মামলা নিয়ে তুমুল আলোচনার দুই দিন পর একই বাদী নুরদের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেন কোতয়ালি থানায়। এতে তিনি মামুনের পাশাপাশি সোহাগের বিরুদ্ধে ধর্ষণ এবং বাকি আসামিদের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে ‘কুৎসা’ রটানোর অভিযোগ আনেন।
পরে সাইবার বুলিং চলতে থাকায় ২৩ সেপ্টেম্বর শাহবাগ থানায় আরও একটি মামলা করেন ওই ছাত্রী।
গত ৪ অক্টোবর আসামিদের গ্রেফতারে ঢাকা মহানগর হাকিম বেগম মাহমুদা আক্তারের আদালতে আবেদন করেন বাদী। বলেন, আসামিরা গ্রেফতার না হওয়ায় তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
বাদীর আইনজীবী হেমায়েত উদ্দিন খান হিরন জানান, বিচারক বলেছেন যেহেতু মামলাটি আমলযোগ্য ও গ্রেফতারি পরোয়নাযোগ্য, জামিন অযোগ্য। তাই পুলিশ কোন সময় তাকে (নুর) গ্রেফতার করতে পারে। আলাদা করে আদালতের আদেশের দরকার নেই।
নুর, মামুনসহ আসামিদের গ্রেফতারের দাবিতে বৃহস্পতিবার রাত নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ অনশন শুরু করেছেন বাদী।
এই তরুণীর দাবির বিষয়ে লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আশরাফ উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলা হলেই বিবাদীকে গ্রেফতার করতে হবে, এমন কোনো বিধান নেই।’
কোতয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, তার থানায় করা মামলায় প্রধান আসামি নাজমুল হাসান সোহাগকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
৫ আসামি প্রকাশ্যে না থাকলেও নুর নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে আসছেন, সংবাদমাধ্যমের সামনে কথাও বলছেন।