অমর একুশে বইমেলা- চলছে বাঙালির প্রাণের উৎসব। লেখক-পাঠক আর প্রকাশকদের মিলনমেলা।
এ বছর মেলায় ৬৩৫টি স্টল ও ৩৭টি প্যাভিলিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের স্টলগুলোকে নান্দনিক স্টাইলে সাজানোয় দর্শনার্থীর নজর কাড়ছে। এর মধ্যে টিনের ঘরের আদলে তৈরি আকাশ প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে পাঠক-দর্শনার্থীর কিছুটা ভিড় লক্ষ করা গেছে।
এছাড়াও নবান্ন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, অন্যপ্রকাশ, বায়ান্ন প্রকাশনীও তাদের স্টলের ডিজাইনে গ্রামীণ পরিবেশের ছোঁয়া নিয়ে আসায় এসব স্টলে চলছে বই দেখার পাশাপাশি ছবি তোলার প্রতিযোগিতা।
শনিবার মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, ১৯ নম্বর প্যাভিলিয়নটি বরাদ্দ পাওয়া আকাশ প্রকাশনী টিনের তৈরি ঘরের আদলে তাদের প্যাভিলিয়নটি সাজিয়েছে। রং, তুলি, বাঁশ, বেত আর ঐতিহাসিক বিভিন্ন ছবি দিয়ে রাঙানো হয়েছে পুরো স্টল। আর স্টলের বাইরের অংশে শোভা পাচ্ছে ভাষা শহীদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছবি।
স্টলটি ঘিরে ব্যাপক উচ্ছ্বাস লক্ষ করা গেছে দর্শনার্থীদের। তাদের অনেকেই বই দেখছেন আবার কেউ তুলছেন ছবি। অনেকেই প্রশংসা করছেন স্টলের নান্দনিক সৌন্দর্যের।
আকাশ প্রকাশনীর প্রকাশক আলমগীর শিকদার লোটন বলেন, ‘ঢাকা শহরের ছেলে-মেয়েরা শহুরে পরিবেশ দেখে হাঁপিয়ে উঠেছে। তাদের অনেকেই গ্রামের পরিবেশ দেখেনি। তাই আমরা এবার গ্রামীণ পরিবেশকে ফুটিয়ে তুলতে টিনের ঘরের আদলে স্টল সাজিয়েছি। এখনও ২৫ শতাংশ কাজ বাকি। তখন আরও ভালো লাগবে দেখতে।’
এই প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী বলেন, ‘যারা পাঠক তারা বই কিনছে। অনেকেই আাবার ছবি তুলতে আসছে। আবার এরকম দেখা যাচ্ছে যে, ছবি তুলতে এসে আমাদের বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়ে অনেকে নাম লিখে যাচ্ছে পরে কিনবে বলে। ইউনিক স্টলের এটাই ভালো দিক যে ছবি তুলতে এসে মানুষ বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হতে পারছে।’
স্টলটির সামনে ছবি তুলার সময় কথা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জয়নাল আবেদীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘অন্য স্টলগুলো সাধারণত গতানুগতিক মানের হয়। কিন্তু এই স্টলটি ভিন্ন। বইমেলায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে এই স্টলটি নজর কাড়ে। আমার মনে হয় যে কেউ এই স্টলে অন্তত একবার হলেও ঘুরে যেতে চাইবেন। তাদের কনসেপ্টটা দারুণ এবং প্রশংসার দাবি রাখে।’
গ্রামীণ পরিবেশের আদলে বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি নবান্ন প্রকাশনীর পরিচালক আশিক আজিজ বলেন, ‘আমাদের সবকিছু ব্যতিক্রম। আমাদের নামটাও ব্যতিক্রম। এই নবান্ন হলো লোকজ ঐতিহ্যের একটা বিষয়। নামের সাথে যোগসূত্র রেখে আমরা প্রতিবছর এই স্টলটি সাজাই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের এখানে ছবি তোলার জন্য একটা অংশ রেখেছি। অনেকেই আমাদের এখানে ছবি তুলতে আসে। বইও কিনছে। সব মিলিয়ে ভালোই সময় যাচ্ছে আমাদের।’
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের প্রো-অর্গানিয়ার দুলাল মাহমুদ বলেন, ‘প্রাকৃতিক বিষয়টা আমরা আমাদের স্টলে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। এবার আমরা বাঁশ দিয়ে স্টল সাজিয়েছি। এই স্টল সাজানোর সরঞ্জামগুলো বান্দরবানের লামা থেকে সংগ্রহ করেছি। গত বছর আমরা নান্দনিক স্টাইলের স্টল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি। আশা করি এবারও আমরা পাঠকদের মনে জায়গা করে নিতে পারবো।’
খোলা ম্যানহোলে দুর্ঘটনার শঙ্কা
বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে কালী মন্দিরের পাশের প্রবেশমুখ দিয়ে ঢুকে কিছুদূর যেতেই চোখে পড়েছে অর্ধখোলা ম্যানহোল। বাংলা একাডেমির তথ্যকেন্দ্রের পাশে এবং চারুলিপি প্রকাশনীর বিপরীত পাশে এটির অবস্থান। মেলায় আগতরা অসাবধানতাবশত এই অর্ধখোলা ঢাকনায় পা দিলে যেকোনো সময় পড়ে পানিতে তলিয়ে যেতে পারেন।
পাশেই থাকা চারুলিপি প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মী গোলাম কাদের বলেন, ‘কালকে (শুক্রবার) এই অর্ধখোলা ম্যানহোলে একজন প্রায় পড়ে যাচ্ছিল। এই ম্যানহোলের গভীরতা অনেক হওয়ায় যেকোনো সময় এটি বড় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। এটি সম্পূর্ণ ঢেকে দিলে ভালো হয়।
এ বিষয়ে তথ্যকেন্দ্রে থাকা একাডেমির এক কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি সেখানে মানুষকে সতর্ক করতে কয়েকটি কাঠ দিয়ে তীর চিহ্ন এঁকে দেন। জানান, এটি তারা নোট রেখেছেন। কাল ঢেকে দেবেন।
মেলায় নতুন বই এসেছে ৭৪টি
শনিবার মেলার তৃতীয় দিনে নতুন বই এসেছে ৭৪টি।
এদিন বিকেল ৪টায় মেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘দ্বিশতজন্মবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি: মাইকেল মধুসূদন দত্ত’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রফিকউল্লাহ খান। আলোচনায় অংশ নেন খসরু পারভেজ ও হোসনে আরা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মুহম্মদ নূরুল হুদা।
প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলা সাহিত্যে মাইকেল মধুসূদন-বিচার কেবল মননশীল সাহিত্য-সমালোচনার বিষয় নয়, সমগ্র ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যক্তিসত্তা, সমাজসত্তা ও সৃষ্টিশীলতার জাগরণ এবং সাহিত্যের প্রায় সব রূপের উন্মেষ ও প্রতিষ্ঠার বহুমুখী পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সাফল্যের ইতিবৃত্ত। তার কিংবদন্তিতুল্য জীবন ও কর্মের সম্পূর্ণ বাস্তবসম্মত রূপ অঙ্কনের প্রয়াস আজও চলমান।
আলোচকবৃন্দ বলেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন তার যুগের থেকেও অগ্রসর। বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে তিনি এনেছিলেন আধুনিকতার যুগ। চিরায়ত সাহিত্যের প্রতি তার বিশেষ অনুরাগ থাকলেও তার সাহিত্যে চিরায়ত ও রোমান্টিকতার সহাবস্থান লক্ষ করা যায়।
সভাপতির বক্তব্যে মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন,’ মাইকেল মধুসূদন দত্ত এমন একজন সৃষ্টিশীল সত্তা যিনি বিভিন্ন ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেছিলেন, বিভিন্ন ভাষার মৌলিক সাহিত্য পাঠ করেছিলেন এবং নিজস্ব মৌলিকতা সৃষ্টি করেছিলেন। তার এই মৌলিকতাকেই আমরা বলি আধুনিকতা।’
লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল, কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক সালেহা চৌধুরী, লালন গবেষক আবু ইসহাক হোসেন এবং কবি ও প্রাবন্ধিক মামুন মুস্তাফা।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেন কবি নাসির আহমেদ, তারিক সুজাত, শাহনাজ মুন্নী এবং নাহার মনিকা। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী মিলন কান্তি দে, শাহাদাৎ হোসেন নিপু এবং আফরোজা কণা।
রোববারের সূচি
রোববার বইমেলা শুরু হবে বিকেল ৩টায়, চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হবে ‘স্মরণ: কাঙাল হরিনাথ মজুমদার’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন তপন মজুমদার। আলোচনায় অংশ নেবেন জাফর ওয়াজেদ ও আমিনুর রহমান সুলতান। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন মুনতাসীর মামুন।