বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

মুখের ক্যান্সার রোগী এত বেশি কেন?

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ১৮ অক্টোবর, ২০২৫ ০০:১৩

একজন বিখ্যাত ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের উক্তি- ‘ক্যান্সারে যত লোকের মৃত্যু হয়, চিকিৎসায় দেরি হওয়ার জন্য মারা যায় সম সংখ্যক লোক’। বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে বিশ্বব্যাপী অসংখ্য লোক দেরী করে ডাক্তারের কাছে আসেন, যার ফলে ইতোমধ্যে ক্যন্সার মারাত্মক রূপ ধারণ করে। গবেষণায় দেখা যায়, এর কারণ হলো, জনসাধারণের মধ্যে রয়েছে ‘ক্যান্সার ভীতি,’ এমন ধারণা যে ক্যান্সার দুরারোগ্য ব্যাধি, এর নিরাময় নেই। অথচ প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে অধিকাংশ ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য। ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে দেহে যে সকল প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যায়, এ সম্বন্ধে অনেকে অবহিত নন। এলডাস হাক্সলির একটি উক্তি উল্লেখ্য, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে অজ্ঞতাই দায়ী, আমাদের অজ্ঞতার কারণ হলো আমরা জানতে চাই না।’ ক্যান্সারকে মোকাবিলা করার প্রথম শর্ত হলো রোগ সম্বন্ধে জানা, এর প্রাথমিক লক্ষণ গুলোকে সনাক্ত করা এবং অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া। কোনো ক্রমেই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া যেন বিলম্বিত না হয়, কারণ এতে রোগ অগ্রসর হতে থাকে এবং পরবর্তীতে দেহের বিভিন্ন স্থানে ক্যান্সার কোষের উপনিবেশ গড়ে ওঠে। এই দুরারোগ্য পর্যায়ে রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে আসেন তখন করার বিশেষ কিছু থাকে না।বাংলাদেশে মুখগহ্বর এ ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। নতুন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। খাদ্যনালি কিংবা মুখগহ্বরের কোনো অংশে ক্যান্সার হলে একপর্যায়ে রোগীর জন্য খাবারদাবার গ্রহণের স্বাভাবিক নিয়ম কষ্টকর হয়ে পড়ে। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাবার তো খেতেই হবে সেই সাথে ক্যান্সার সংক্রান্ত অন্যান্য জটিলতা তো আছেই।মুখগহ্বর এর ক্যান্সারের সঙ্গে একজন মানুষের প্রতিদিনের জীবনধারা বিশেষভাবে সম্পর্কিত। যেসব অভ্যাসের কারণে মুখগহ্বরের সরাসরি ক্ষতি হয়, সেগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া আবশ্যক। যেমন তামাক মুখগহ্বর ও খাদ্যনালির শত্রু, সেটা যেভাবেই তা গ্রহণ করা হক না কেন। তামাক ও তামাকজাত দ্রব্যের কারণে মুখগহ্বর ও খাদ্যনালির কোষে ক্ষত সৃষ্টি হতে থাকে। এই ক্ষত থেকেই এক সময় ক্যান্সার হয়।সিগারেট, ই-সিগারেট, পান, সাদাপাতা, সুপারি, চুন, জর্দা, গুল, খইনি-সবই মুখগহ্বর ও খাদ্যনালির ক্যানসারের জন্য দায়ী। আমাদের দেশের বহু মানুষ এসব তামাকের কোনো না কোনোটি গ্রহণ করেন। বর্তমান সময়ে তরুণদের মধ্যে ধূমপানের হার অনেক বেড়েছে। আমাদের দেশের যত মানুষ মুখগহ্বর ও খাদ্যনালির ক্যানসারে আক্রান্ত, তাদের ৮০-৯০ শতাংশেরই তামাক বা তামাকজাত পণ্য সেবনের কারন রয়েছে। সেইসাথে অ্যালকোহল ও অনেকে পানের সাথে জর্দ্দা ব্যবহার করেন, এ ধরনের নেশাও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।

যারা পানের সঙ্গে জর্দ্দা খান এবং নিয়মিত অনেকবার পান খান তাদের মুখের ঘা বেশি হয় এবং লক্ষ্য করা গেছে অনেকেই তামাক পাতাকে হাতের মধ্যে নিয়ে চুনের সঙ্গে মিশিয়ে গালের মধ্যবর্তী স্থানে রাখেন, তাতে দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ওই স্থানে ঘা হতে পারে। শুধু ঘা নয় পরবর্তীতে এই ঘা ক্যান্সারেও রূপ নিতে পারে। শুধু বাংলাদেশেই নয় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে যেখানে তামাক পাতা নেশার মতো ব্যবহৃত হয় সে সমস্ত অঞ্চলেও মুখের ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা অন্যান্য দেশের চাইতে বেশি। অর্থাৎ যারা জর্দ্দা খান বা তামাক পাতা খান তাদের রিস্ক-ফ্যাক্টর বা ঝুঁকি হতে পারে ৬০ ভাগ এবং যারা ধূমপান করেন এবং সেই সাথে তামাক পাতা ও পানের সঙ্গে ব্যবহার করেন তাদের ঝুঁকি শতকরা ৮০ ভাগ।

গত বিশ বছরে বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় ১০ গুন বেড়েছে। পুরুষ-মহিলা-শিশু নির্বিশেষে সবারই ক্যান্সার হয়। মুখগহ্বরের ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব পুরুষদের ক্ষেত্রে ২২%-২৩% এবং মেয়েদের মধ্যে ১৬%-১৭%। বর্তমান পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় দুই লক্ষ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার মৃত্যুবরণ করে। সারা পৃথিবীতে বর্তমানে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রায় দুকোটির কাছাকাছি।ক্যান্সার এমন এক ব্যাধি, যার বৈশিষ্ট্য হলো অস্বাভাবিক কোষের নিয়ন্ত্রণহীন বৃদ্ধিও বিস্তার। স্বাভাবিক অবস্থায় দেহ কোষগুলোর ক্ষেত্রে সুশৃঙ্খল পুনঃজন্ম ঘটে এবং এদের বৃদ্ধি হয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে মুখগহ্বরের ক্যান্সার বাংলাদেশে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতে বেশি হয়। সূচনায় চিহ্নিত হলে নিরাময়ের সম্ভাবনা খুবই উজ্জল। ডেন্টাল সার্জনরা মুখ গহ্বরের রুটিন পরীক্ষার সময় অনেক ক্ষেত্রে একে শনাক্ত করেন। মুখ গহ্বরের ক্যান্সারের মধ্যে জিহ্বায় হয় ২০%, ঠোঁটে ১৫% এবং লালাগ্রন্থি ১০%। ২৫% শতাংশ হলো গলদেশের ক্যান্সার। এছাড়া মাড়ি, তালু, টনসিল, চোয়ালেও এই ক্যান্সার হয়। যারা ধূমপান করেন, তাদেরই মুখে ক্যান্সার বেশি হয়। বিভিন্ন গবেষনায় বলা হয়েছে সিগার ও পাইপ খেলেও মুখের ক্যান্সার হয় খুব বেশি। যদি লক্ষ্য করা যায় যে, মুখ গহ্বরের একটি ক্ষত বা ঘা যা শুকাচ্ছে না, এবং সহজেই এ থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, গিলতে অসুবিধা হচ্ছে, সব সময় গলায় কোনো কিছুর উপস্থিতি অনুভুত হচ্ছে, তাহলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ প্রয়োজন। এরকম লক্ষণ হওয়া মানেই ক্যান্সার নয়- শুধু প্রয়োজন হলো একজন ডাক্তার দেখিয়ে নিশ্চিত হওয়া। এ ব্যাপারে ডেন্টাল সার্জন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে যেমন মুখ গহ্বর এর রুটিন পরীক্ষার সময় অথবা অন্য সময় যখন দাঁত বা মুখ গহ্বরের চিকিৎসা করছেন তখন তাদের দায়িত্ব হবে মুখ গহ্বরের কোষকলায় কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য করা। সুতরাং কেউ যদি নিয়মিত ডেন্টাল সার্জন দিয়ে বছরে অন্তত একবার মুখের চেক আপ করান, তাহলে এরকম কিছু ঘটে থাকলেও চিকিৎসক সূচনাকালেই একে শনাক্ত করতে পারেন।গবেষণায় যত রকমের ক্যান্সার দেখা গেছে তার শতকরা ত্রিশ ভাগ ক্ষেত্রের কারণ হলো তামাক। ফুসফুসের ক্যান্সার জনিত মৃত্যুর শতকরা নব্বই ভাগের জন্যই দায়ী তামাক। তামাক শুধু ফুসফুসের ক্যান্সারের অন্যতম কারণ নয় মুখের ভিতরের বিভিন্ন রকম ক্যান্সারের জন্য দায়ী।এ ছাড়া যারা মুখগহ্বরের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে যত্নশীল নন কিংবা যাদের দাঁতের অংশ অত্যধিক ধারালো, তাদের মুখের ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি। বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা খাবার খেলেও হতে পারে মুখের ক্যান্সার। যাদের ডায়াবেটিস আছে এবং তা নিয়ন্ত্রণে থাকে না, তাদের এই মুখের ক্যান্সার হওয়ার প্রবণতা অন্যদের চাইতে বেশি।মুখের ভেতরের ক্যান্সার প্রতিরোধে তামাক সেবক অর্থাৎ সিগারেট, বিড়ি, হুক্কা, দোক্তা, কিমা, খৈনী, গুল, নাস্যি গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। ক্যান্সার মানেই মৃত্যু কথাটি কোন এক সময় হয়ত সত্য ছিল, কিন্তু আজ আর তা নয়। বর্তমানে অর্ধেক ক্যান্সারকে আমরা প্রতিরোধ করতে পারি। বাদবাকী অর্ধেকের বেশি ভাগটাই আমরা সূচনায় ধরে ফেলে সঠিক চিকিৎসা করতে পারি। প্রতিকারসাধারণভাবে মুখগহ্বর ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য অস্ত্রোপচার ও রেডিওথেরাপিই মূল চিকিৎসা। কোনো কোনো রোগীর কেমোথেরাপিরও প্রয়োজন হতে পারে। নির্ধারিত থেরাপিরও সুযোগ রয়েছে। যাঁরা নিয়মিত তামাক বা তামাকজাত পণ্য গ্রহণ করেন, তাদের কোনো উপসর্গ না থাকলেও চিকিৎসকের পরামর্শ মাফিক কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো উচিত। কারণ, প্রাথমিক অবস্থায় ক্যান্সার ধরা পড়লে চিকিৎসা পদ্ধতি সহজ হয়। যেমন এসব ক্ষেত্রে বায়াপসি বা মাংস পরীক্ষা করা জরুরি। তাহলে সুর্নিদিষ্টভাবে তার রোগ র্নিনয় বা ক্যান্সার কোন পর্যায়ে রয়েছে তা জানা যায়।

প্রতিরোধমুখগহ্বর এর ক্যান্সার প্রতিরোধে করনীয়-

• ধূমপান, তামাক ও তামাকজাত কোনো পণ্য সেবন বন্ধ করা । • মুখগহ্বর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা। প্রতিদিন দুবেলা দাঁত ব্রাশ এবং খাওয়ার পর ভালোভাবে কুলকুচি করা প্রয়োজন। • দাঁতের কোন অংশ ধারালো থাকলে চিকিৎসা করা।• ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা ।• প্রচুর ফলমূল ও শাকসবজি গ্রহণ এবং আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ। • শারীরবৃত্তীয় কারণে মহিলাদের আয়রনের ঘাটতি বেশি হয়। তাদের পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ নিশ্চিত করা আবশ্যক।• ফাস্টফুড বা প্রোসেস ফুড বাদ দেওয়া প্রয়োজন। • অতিরিক্ত অ্যাসিডিটি থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহন করা।• অতিরিক্ত ঝাল কিংবা অতিরিক্ত গরম খাবার ও পানীয় বর্জন করা।• সব ধরনের মাদক ও অ্যালকোহল বর্জন করা।

সবচেয়ে বড় কথা , যদি আমরা তামাক, ধূমপান, জর্দ্দা ইত্যাদি বর্জন করতে পারি, তাহলে মুখের ক্যান্সার, গলার ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সারসহ অনেক ক্যান্সার রোগকেই প্রতিরোধ করতে পারব।

লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত শব্দসৈনিক।

এ বিভাগের আরো খবর