রাজধানীতেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে উত্তরাঞ্চলের বিখ্যাত খাবার ‘কালাই রুটি’। ঢাকার বিভিন্ন অংশে অল্প সময়ে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু কালাই রুটির দোকান।
মাসকলাই আর চালের আটার মিশেলে হাতে বানানো এই রুটি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। এতে রয়েছে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, কার্বোহাইড্রেট ও মিনারেল।
উত্তরের জেলাগুলোতে, বিশেষ করে চরাঞ্চলে মাসকলাইয়ের ডালের আবাদ বেশি হয়। এই মাসকলাইয়ের আধিক্যের কারণে এসব এলাকায় কালাই রুটির উদ্ভব, তবে ঠিক কবে থেকে এই রুটির প্রচলন, তা জানা সম্ভব হয়নি।
কথিত আছে, উত্তরের জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের দিয়াড় এলাকায় প্রথম কালাই রুটি তৈরি শুরু হয়। পরে তা রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, ঠাকুরগাঁসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
কালাই রুটি মূলত কৃষিকাজে নিয়োজিত দিনমজুরদের খাবার। চরাঞ্চলের আবহাওয়ার কারণে মরিচ-ঝাল দিয়ে খাওয়া এই রুটি কায়িক পরিশ্রমের জন্য উপকারী।
ফসলের মাঠ থেকে উঠে আসা কালাই রুটি এখন রেস্তোরাঁয় জায়গা করে নিয়েছে। রাজধানীতে কিছু তরুণ উদ্যোক্তার হাত ধরে গড়ে উঠেছে কালাই রুটির বেশ কিছু দোকান।
ঢাকায় বসেই এখন এ রুটির স্বাদ নিতে পারছেন নগরবাসী। মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, মিরপুরসহ ঢাকার অনেক এলাকায় চোখে পড়ে রুটির দোকান।
সাংবাদিকতা ছেড়ে ২০২০ সালে ঢাকার মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে ‘কালাই রুটির আড্ডা’ নামের একটি রেস্তোরাঁ চালু করেন জামিলুর রহমান।
‘ঐতিহ্য রক্ষায় সচেষ্ট’ স্লোগানে শুরু করা এই ব্যবসায় তার সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে কারিগর এনে স্থানীয় স্বাদে পরিবেশন করা এই বিশেষায়িত রেস্তোরাঁ অল্প দিনেই জনপ্রিয়তা পায়।
মাসকলাই আর চালের আটার মিশেলে হাতে বানানো ‘কালাই রুটি’। ছবি: নিউজবাংলাকী বলছেন রেস্তোরাঁর উদ্যোক্তারা
নিজ জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঐতিহ্যকে ঢাকায় ছড়িয়ে দিতে রেস্তোরাঁ ব্যবসায় নামেন জামিলুর রহমান। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘একটা সময় ছিল শুধু উত্তরাঞ্চলের মানুষ কালাই রুটি খেত, কিন্তু সময়টা এখন বদলে গেছে। এখন সবাই কালাই রুটি পছন্দ করে। আমরা কখনও ভাবতে পারিনি ঢাকা শহরের মানুষ কালাই রুটি গ্রহণ করতে পারবে।’
মোহাম্মদপুরের পর খিলগাঁওয়েও এ রেস্তোরাঁর একটি শাখা চালু হয়েছে। ‘কালাই রুটির আড্ডা'য় রুটির সঙ্গে বেগুন ভর্তা, লবণ-ঝাল ভর্তা, ধনে পাতা ভর্তা, রসুন ভর্তা, টকঝাল ভর্তা, আচার, শুঁটকি ভর্তা ও আলু ভর্তা পরিবেশন করা হয়। এ ছাড়া হাঁসের মাংস, গরুর ভুনা, বট (গরুর ভুঁড়ির ভুনা), চিকেন ভুনাও পাওয়া যায় রেস্তোরাঁটিতে।
কালাই রুটির স্বাদ নিতে রেস্তোরাঁয় রাজধানীবাসীর ভিড়। ছবি: নিউজবাংলা‘কালাই রুটির আড্ডা’র মতোই মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে আছে আরও একটি রেস্তোরাঁ। নাম ‘কালাই কুঠির’। নাটোরে গিয়ে কালাই রুটি মনে ধরে যায় এই প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম অংশীদার ফরহাদ আহমেদের। রুটির পুষ্টিগুণে অভিভূত হয়ে প্রায় দুই বছর আগে রেস্তোরাঁটি চালু করেন ফরহাদ।
ভালো সাড়া পাওয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যে ‘কালাই কুঠির’-এর তিনটি শাখা চালু করেছেন তারা। এগুলো মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোড, রিং রোড ও কৃষি মার্কেট এলাকায়।
ফরহাদ বলেন, ‘আমাদের এখানকার শেফ, ওয়েটারসহ রুটি বানানোর পুরো সেটটাই উত্তরবঙ্গ থেকে নিয়ে আসা। তারা সবাই অভিজ্ঞ। রুটির আসল স্বাদ ধরে রাখতে এই আয়োজন।’
কালাই কুঠিরে লবণ-ঝাল ভর্তার পাশাপাশি কবুতরের মাংস, গরুর মেজবান, হাঁসের মাংসও পাওয়া যায়।
ফসলের মাঠ থেকে এখন রেস্তোরাঁয় জনপ্রিয় কালাই রুটি। ছবি: নিউজবাংলাফুটপাতেও জমজমাট ব্যবসা
কালাই রুটির আড্ডা ও কালাই কুঠিরের মতো রেস্তোরাঁর বাইরে ঢাকায় স্ট্রিট ফুড বা ফুটপাতের দোকানেও কালাই রুটি পাওয়া যায়। মিরপুর-২-এর ‘চাপাই কালাই রুটি অ্যান্ড বিরিয়ানি হাউস’ তেমনই একটি। এখানেও জমজমাট ব্যবসা। কালাই রুটির সঙ্গে বিভিন্ন পদের ভর্তা আর হাঁসের মাংসের স্বাদ নিতে এখানে আসেন অনেকে।
মিরপুরের নূরানী মসজিদের পাশে কালাই রুটির এই ব্যবসা শুরু করেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার বাসিন্দা মো. সোহেল রানা। দেড় বছর আগে জুতার ব্যবসার পাশাপাশি এই দোকান খোলেন তিনি।
সোহেল বলেন, ‘আটাটা আমরা রাজশাহী থেকে আনি। কারিগর রাজশাহীর। আমার দোকানে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী কাস্টমার আসে। বেচাকেনা অনেক ভালো।’
এই দোকানে প্রতি পিস কালাই রুটি বিক্রি হয় ২৫ টাকা দরে। অন্যান্য জায়গার মতো এখানেও লবণ-ঝাল ভর্তা, বেগুন ভর্তার পাশাপাশি হাঁসের মাংস, গরুর মাংস পাওয়া যায়।
এখানে খেতে আসা চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা আহসান উদ্দিন বলেন, ‘সবচেয়ে ভালো হলো নুন-ঝাল আর বেগুন ভর্তা। এটা আমাদের খুব ফেভারিট, ঐতিহ্যবাহী।’
মোহাম্মদপুরের ‘কালাই রুটির আড্ডা’য় বন্ধুদের নিয়ে উদযাপনে আসা লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা তৌহিদুর রহমান জানান, ‘জীবনে প্রথমবারের মতো কালাই রুটি আস্বাদনে এসেছি। আমি এই ফার্স্ট কালাই রুটি খাইলাম। খেয়ে মনে হলো ভালো, খাবারটা ভালো আর কী।’
ছয় বন্ধুকে কালাই রুটির সঙ্গে পরিচয় করাতে রেস্তোরাঁয় আসেন শামসুল আলম। চাঁপাইনবাবগঞ্জের এ বাসিন্দা বলেন, ‘আমাদের দিকে বেসিক্যালি লবণ-ঝাল দিয়ে খায়। এখন বেগুন ভর্তাও বেশি খায়। হাঁসের মাংস ও বট খায়, তবে কম। কারণ আমাদের এলাকায় এসবের প্রচলনটা কম।’
বন্ধুদের নিয়ে উদযাপনে আসেন অনেকেই। ছবি: নিউজবাংলা‘কালাই কুঠির’ নামের রেস্তোরাঁয় খেতে আসা কুষ্টিয়ার বাসিন্দা প্রিয়া বলেন, ‘গ্রামে তো আসলে যাওয়া হয় না। ঢাকায় যেহেতু এখন পাচ্ছি, আমার খুব পছন্দ। এ জন্য মিস করি না। খাবারটা খুব ভালো লাগে; মাঝেমধ্যেই এখানে খেতে আসি।’
রেস্তোরাঁভেদে প্রতি পিস কালাই রুটির দাম ৩০ থেকে ৫০ টাকা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভর্তার দাম। আর মাংসের আইটেম মিলবে ১৩০ থেকে ১৭০ টাকার মধ্যে।
রেস্তোরাঁগুলোতে গড়ে প্রায় ৩০০ জন কালাই রুটি খেতে আসেন। দিনে বিক্রি হয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার।
যেভাবে তৈরি হয় রুটি
অন্যসব রুটির চেয়ে স্বাদে ব্যতিক্রম কালাই রুটি। কারণ উপাদান আর বানানোর পদ্ধতির ভিন্নতা। তিন ভাগ চালের আটার সঙ্গে এক ভাগ কালাইয়ের আটা মিশিয়ে পরিমাণমতো লবণ ও পানি যুক্ত করে খামির বানানো হয়। প্রথাগত বেলনের বদলে হাতের তালুর চাপে ধীরে ধীরে তৈরি করা হয় রুটি। পরে মাটির তাওয়ায় স্যাঁকা হয়।
হাতের তালুর চাপে ধীরে ধীরে তৈরি করা এ রুটি স্যাঁকা হয় মাটির তাওয়ায়। ছবি: নিউজবাংলা‘চাপাই কালাই রুটি অ্যান্ড বিরিয়ানি হাউস’-এর কারিগর মো. ইয়াসিন আলী ৩০ বছর কালাই রুটির দোকান চালিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে।
তিনি বলেন, ‘আমি দুই হাত দিয়ে কালাই রুটি তৈরি করি। পিঁড়িতে করা যায় না। বেলনে হয়, তবে মজা লাগে না খেতে।’
১০ বছর ধরে কালাই রুটি বানাচ্ছেন ‘কালাই রুটির আড্ডা’র কারিগর আব্দুস সাত্তার। তিনি বলেন, ‘এই রুটিটা হাত ছাড়া হয় না। এটা হাতেরই রুটি, বেলনের রুটি না।’
সাত্তার আরও বলেন, ‘এই রুটি মাটির তাওয়া ছাড়া হয় না। রুটি তাওয়াতে ছাড়ার পরে হালকা সেঁকে উল্টিয়ে দিতে হবে। উল্টিয়ে দিলে রুটির ভেতরটা ফুলবে। না ফুললে কিন্তু মজা নাই কালাই রুটির।’
‘কালাই কুঠির’-এর কারিগর নুরুল ইসলাম জানান, ‘লাল করে ভাইজলে এটা মজা। হালকা কড়া করলে মজা বেশি, দাঁতের সমস্যায় নরম করেও খেতে পারবেন।’
উত্তরবঙ্গের তুমুল জনপ্রিয় এই কালাই রুটির চাহিদা প্রতিনিয়ত বাড়ছে রাজধানীতে। স্বাদে-গুণে ভালো হওয়ায় অনেকেই ছুটছেন এর স্বাদ নিতে।