রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাতে আগে প্রায়ই দেখা যেত জোঁকের তেল কিংবা সান্ডার তেল। পুরুষের যৌনশক্তি বাড়ানোর ‘অব্যর্থ দাওয়াই’ হিসেবে এগুলো বিক্রি হতো।
প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে ফুটপাতের সেসব ভ্রাম্যমাণ দোকান এখন বলতে গেলে উধাও। তবে বিভিন্ন কবিরাজি বা হেকিমি দাওয়াখানায় গোপনে বিক্রি হচ্ছে এসব কথিত তেল।
নিউজবাংলার প্রতিবেদক এমনই এক দাওয়াখানার মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন প্রতারণার তথ্য।
রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় কয়েক বছর আগেও সান্ডা-জোঁকের তেলসহ বাত, চর্ম, যৌনরোগের কথিত ওষুধ বিক্রির হটস্পট হিসেবে পরিচিত ছিল।
তবে গত ১৩ মার্চ বিকেলে ওই এলাকা চষেও এ ধরনের কোনো বিক্রেতার দেখা মেলেনি। ফুটপাতের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, আগে তাদের নিয়মিত দেখা গেলেও এখন আর পুলিশ বসতে দিচ্ছে না।
ছারপোকা, তেলাপোকা মারার ওষুধ বিক্রেতা নিয়ামত উল্লাহ
এর মধ্যে অনেকটা হঠাৎ পাওয়া যায় নিয়ামত উল্লাহ নামে এক মধ্যবয়সীকে। সবজি বাজারের কাছে ছারপোকা, তেলাপোকা মারার ওষুধ বিক্রি করছিলেন তিনি। সান্ডা বা জোঁকের তেল কোথায় পাওয়া যায় জিজ্ঞেস করতেই নিয়ামত বলেন, ‘আমি আগে ওগুলো বিক্রি করতাম। এখন বাদ দিছি।’
সান্ডার তেলের ব্যবসা বাদ দেয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার চেনা-পরিচিত সবাই করোনার মধ্যে সান্ডার তেল বিক্রির ব্যবসা বাদ দিছে। কারণ সে সময় প্রশাসন বেশি লোকজনকে জড়ো হতে দিত না। তা ছাড়া পুলিশের অভিযান আছেই। তাই সবকিছু বিচার-বিবেচনা করে আমিও বাদ দিছি।’
এ ধরনের তেলের ‘গুণ’ বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘সান্ডা আর জোঁকের তেলে জোশ বাড়ে। ভ্যান বা চট বিছিয়ে রাস্তার ধারে হ্যান্ডমাইকে অথবা গলা ফাটিয়ে জোঁক, সান্ডা, এমনকি শিয়ালের তেলও বিক্রি করতাম। বাতব্যথা, চর্ম ও যৌনরোগের চিকিৎসা হয় এসব তেলে। অনেকেই ওপেনে এ তেল কিনত, আবার কেউ কেউ কিনত গোপনে।’
হেকিমি দাওয়াখানায় কথিত সান্ডার তেলের শিশি
নিয়ামত এখনও ফুটপাতে ব্যবসা চালালেও সান্ডা-জোঁকের তেল বিক্রি ছেড়ে দিয়েছেন। ভ্যানের ওপর ছোট্ট সাউন্ড বক্স বসিয়ে বিক্রি করছেন ছারপোকা ও তেলাপোকা মারার ওষুধ।
নিয়ামত উল্লাহর বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট। একসময় এলাকার হাটবাজারে সান্ডা-জোঁকের তেলসহ নানা ধরনের কবিরাজি উপকরণ বিক্রি করতেন। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে গান গাইতেন।
সেসব গানের দু-এক লাইন শুনতে চাইতেই মুচকি হেসে তিনি বলেন, ‘ওগুলো এখন বলতে গেলে নিজেরই লজ্জা লাগে। যখন ব্যবসা করতাম, তখন অভ্যাস ছিল। এখন আর বলতে পারব না।’
নিয়ামত জানান, সান্ডা বা জোঁকের তেল এখনও বিক্রি করছেন এমন একজনের খোঁজ তার কাছে রয়েছে। চাইলে তার কাছে নিয়েও যেতে পারেন তিনি।
সম্মতি দিতেই নিজের দোকান রেখে কারওয়ান বাজারের আম্বর শাহ মসজিদ মার্কেটের নিচতলার একটি দোকানে নিয়ে যান নিয়ামত।
মডার্ন হারবাল দাওয়াখানার মালিক কবিরাজ মো. শরীফ
দোকানটির নাম মডার্ন হারবাল দাওয়াখানা। এর মালিক ৫৬ বছর বয়সী কবিরাজ মো. শরীফ। শরীফের দোকানে কিছু সার্টিফিকেট ও প্রশংসাপত্র ঝুলতে দেখা যায়। এর মধ্যে একটি সার্টিফিকেটে লেখা ‘চট্টগ্রাম ইউনানী তিব্বিয়া কলেজ’।
সান্ডার তেল চাইতেই শরীফ কবিরাজের প্রশ্ন, ‘কত শিশি লাগবে? শুধু কি আপনার জন্য, নাকি বন্ধু-বান্ধবের জন্যও নিয়ে যাবেন?’
আশ্বস্ত করে তিনি বলেন, ‘লুকানোর কিছু নেই, যৌনরোগ ইদানীং ইয়াংদেরই বেশি হচ্ছে। অনেক ভদ্রলোক এসব সমস্যা নিয়ে নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে শেষে আমার কাছে এসে নিয়ে যায়।’
সমস্যা সমাধান হয় কি না জানতে চাইলে শরীফ খানিকটা বিব্রত হন। তবে তিনি বলেন, ‘সমাধান না হইলে শত শত মানুষ আসে কেন? আগে ব্যবহার করেন তারপর এসে কইয়েন। এই যে আমারে দেখেন। এক পা কবরে গেছে, অথচ এখনও আমি স্ট্রং। আমার ব্যবসার বয়স ৩০ বছর। আগে ফুটপাতে বেচতাম, এখন নানা ঝামেলায় এখানে বেচি।’
কোন শ্রেণির রোগীরা আসেন- জানতে চাইলে শরীফ বলেন, ‘আমার এখানে বড়লোক, ছোটলোক বলে কথা নেই। যৌন সমস্যা গরিব-বড়লোক হিসেবে হয় না। গাছতলা থেকে দশতলার মানুষ আমার কাছে সান্ডার তেল নিতে আসে। কেউ গোপনে, আবার কেউ কেউ ওপেনে আসে।’
শরীফ কবিরাজের দোকানে এক শিশি সান্ডার তেলের দাম ৬০০ টাকা। আর এক শিশি জোঁকের তেলের দাম ৪৫০ টাকা।
কারওয়ান বাজারের মডার্ন হারবাল দাওয়াখানা
সান্ডা-জোঁকের তেল কোথা থেকে সংগ্রহ করা হয় জানতে চাইলে শরীফ বলেন, ‘সান্ডা প্রাণীটা আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। সান্ডা সৌদি আরবের প্রাণী। কিছু ব্যবসায়ী আছে তারা সৌদি থেকে নিয়ে আসে। তাদের কাছ থেকে আমরা কিনি। তারপর নিজে প্রসেস করে বিক্রি করি।
‘আর জোঁক আমাদের দেশে খাল-বিলে পাওয়া যায়। পরিচিত লোকজন আছে তারা গ্রাম থেকে বোতলে করে এনে আমাদের দিয়ে যায়। তারপর সেটা তেলের সঙ্গে মিশিয়ে প্রসেস করে রোগীদের দিই।’
তেল তৈরির পদ্ধতি দেখতে চাইলে ক্ষেপে যান শরীফ কবিরাজ। কড়া গলায় বলেন, ‘আপনার দরকার হলে নিয়ে যান। যাদের কাছ থেকে তেল কিনি তাদের কাছে নিয়ে যাওয়া নিষেধ আছে। আর আমার প্রক্রিয়াও দেখানো যাবে না।
‘সবাই বিশ্বাস করে কেনে। কেউ তো দেখতে চায় না। আপনি দেখে কী করবেন? আপনি কে?’
তবে সংবাদকর্মীর পরিচয় পেয়ে কণ্ঠ শান্ত হয়ে আসে শরীফের। নরম স্বরে তিনি এবার বলেন, ‘বাবা, আমি এই একটাই কর্ম জানি। এই বয়সে অন্য কী আর করব? তাই চুপচাপ দোকান নিয়ে এটা করে খাই। ফুটপাতে অভিযান হয়, পুলিশ আসে। সে জন্য এখানে আয়ুর্বেদিক ওষুধের সঙ্গে এগুলো বিক্রি করি। যে চায়, তারেই শুধু দিই।’
আসলেই সান্ডা-জোঁকের তেল বিক্রি করেন কি না- জানতে চাইলে শরীফ কবিরাজ এবার অন্য কথা শোনান। তিনি বলেন, ‘আমিও শুনছি সান্ডা নামের এক ধরনের প্রাণীর তেল সৌদি আরব পাওয়া যায়। সৌদির শেখরা শুনছি ব্যবহার করে। আমি দেখি নাই। আর জোঁকও এখন পাওয়া যায় না। জোঁকের তেল হয় কি না জানিও না।’
আরও পড়ুন: পাকিস্তানে রমরমা সান্ডার তেলের বাজার
তাহলে তিনি কী বিক্রি করছেন- এমন প্রশ্নে শরীফের সরল উত্তর, ‘নারিকেল তেল আর পাম অয়েল একসঙ্গে করে দুই-একটা গাছের শেকড় দিয়ে আগুনে জ্বালাই। তারপর ছোট ছোট বোতলে করে বিক্রি করি।’
রোগীর সমস্যার সমাধান হয় কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সমাধান হয় কি না বলতে পারব না। নিয়মিত কেউ আসে না। সমাধান হতেও পারে, আবার নাও পারে। কারণ মানুষ মনের বিশ্বাসে এগুলো কেনে। হয়তো এগুলো ব্যবহার করে মনের রোগ কেটে যায়।’
রোগীরা কখনও অভিযোগ নিয়ে আসেন কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে যৌন সমস্যার ব্যাপারে কেউ ওষুধ নেয়ার পর তাতে যদি কাজ না হয় লজ্জার খাতিরে হলেও অভিযোগ করে না।’
দোকানে ঝোলানো সার্টিফিকেট ও প্রশংসাপত্রগুলোও ভুয়া বলে স্বীকার করেন শরীফ কবিরাজ। তিনি বলেন, ‘ওগুলো আসল না। টাকা দিয়ে বানাইছিলাম। রোগীর বিশ্বাস বাড়ে বলে লেমিনেটিং করে ঝুলাইছি।’