যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে গাজায় অব্যাহত রয়েছে ইসরায়েলি হামলা। পশ্চিম তীরে ধরপাকড় অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে দখলদার বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি তৃতীয় সপ্তাহে প্রবেশ করলেও উপত্যকায় এখনো থামেনি ইসরায়েলি আগ্রাসন।কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা জানিয়েছে, গাজার মধ্যাঞ্চলের নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় এক ফিলিস্তিনি নিহত এবং অন্তত চারজন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে আল-আওয়াদা হাসপাতাল।ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, তাদের এই হামলার লক্ষ্য ছিল ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন ইসলামিক জিহাদের এক সদস্য।এদিকে, গত শনিবার গাজা শহরে একটি ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ধসে নয় বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে।‘এখনো নিরাপত্তা নেই’স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রোববার সকালে থেকেই গাজার পূর্বাঞ্চলজুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছে। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইসরায়েলি বাহিনী আবারও ভারী বিস্ফোরক ব্যবহার করছে।পূর্ব দেইর আল-বালাহ ও আল-জুয়াইদা এলাকাসহ একাধিক স্থানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, যা ইসরায়েলি সেনাদের ঘোষিত প্রত্যাহার সীমারেখারও বাইরে।নুসেইরাতের সাম্প্রতিক হামলার পর স্থানীয়রা আরও আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন। তারা বলছেন, যুদ্ধবিরতি থাকলেও যেকোনো সময় আকাশ থেকে হামলা হতে পারে। অনেকের মতে, ‘এখনো কোনো নিরাপত্তা নেই।’গাজায় কাতারি সেনা মোতায়েনের ইঙ্গিতযুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শনিবার এশিয়া সফরের পথে কাতারের আল-উদেইদ বিমানঘাঁটিতে কাতারি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পরে ট্রাম্প জানান, গাজায় স্থিতিশীলতা আনার প্রচেষ্টা অগ্রসর হচ্ছে এবং তার ২০ দফা গাজা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে একটি ‘আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী’ গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে প্রয়োজনে কাতারি সেনারাও থাকতে পারেন।তিনি বলেন, বাহিনীটি খুব দ্রুতই গঠন করা হতে পারে এবং ‘এখনই নেতৃত্ব বাছাই চলছে।’পশ্চিম তীরে ধরাপাকড়অন্যদিকে, দখলকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বাহিনীর নতুন করে গ্রেপ্তার অভিযান শুরু হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হেবরন এলাকায় পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেরুজালেমের কাছে আল-রাম শহরে গুলিতে এক ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন।এছাড়া, নাবলুস শহরেও অভিযান চালানো হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি বলে জানিয়েছে ওয়াফা।‘গাজায় যুদ্ধবিরতি ব্যর্থ হতে দিতে পারে না বিশ্ব’ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক পরিচালক এডুয়ার্ড বেগবেডার বলেছেন, গাজায় যুদ্ধবিরতি শিশুদের বেঁচে থাকা, নিরাপত্তা এবং মর্যাদার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। বিশ্ব এই যুদ্ধবিরতির সুযোগ ব্যর্থ হতে দিতে পারে না।একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, বিবৃতিতে বেগবেডার বলেছেন, ‘গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের ফলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটেছে। আমি শিশুদের ওপর যে মাত্রার প্রভাব দেখেছি, তা কেবল শব্দ এবং সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এটি এমন একটি প্রভাব, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে থেকে যাবে।’তিনি আরও বলেন, ‘আমরা অপুষ্টি, রোগ এবং শীতকালীন ঠাণ্ডার মতো প্রতিরোধযোগ্য হুমকি থেকে শিশুদের জীবন বাঁচাতে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে দৌড়াচ্ছি।’বেগবেদার গাজায় মানবিক সহায়তা প্রবেশকারী সকল ক্রসিং খুলে দেওয়ার এবং ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশের জন্য ছাড়পত্রের প্রক্রিয়া দ্রুত করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিশেষ চিকিৎসার প্রয়োজন- এমন শিশুদের অবিলম্বে চলে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত।গত ৯ অক্টোবর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেন, ইসরায়েল এবং হামাস একটি শান্তি পরিকল্পনার চুক্তিতে পৌঁছেছে। প্রথম পর্যায়ে মধ্যে সমস্ত বন্দিদের মুক্তি এবং ইসরায়েলি সৈন্যদের একটি রেখার বাইরে প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১০ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হয়।এদিকে, গাজা অঞ্চলজুড়ে ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৬৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। একই সময়ে ১ লাখ ৭০ হাজারের বেশি বেশি মানুষ আহত হয়েছে। অনেকেই ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন।চলতি বছরের শুরুতেও একটি যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে ইসরায়েল গত ২৭ মে থেকে গাজায় পৃথক সাহায্য বিতরণ উদ্যোগ শুরু করে। এই পদক্ষেপের পর অঞ্চলটিতে দুর্ভিক্ষ প্রকট হয়ে উঠেছিল।ইসরায়েলি বাহিনী খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের কাছে জড়ো হওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপরও গুলি চালিয়ে যায়। এর ফলে শত শত মানুষ নিহত হয়। সেই সঙ্গে দুর্ভিক্ষে শিশুসহ বহু মানুষের মৃত্যু হয়।গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য নেতানিয়াহু ও তার প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। উপত্যকাজুড়ে যুদ্ধের জন্য ইসরায়েল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলার মুখোমুখি।আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে গাজার পরিস্থিতিশীতের আগমনীর সঙ্গে সঙ্গে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। জরুরি আশ্রয় ও শীতের সামগ্রী প্রবেশে ইসরায়েলের অব্যাহত বাঁধার কারণে বিপদে পড়েছেন লক্ষাধিক বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি। এমনটাই জানিয়েছে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ (UNRWA)। বার্তাসংস্থা আনাদোলুর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়।ইউএনআরডব্লিউএ এক বিবৃতিতে বলেছে, শীতপ্রবণ গাজায় আশ্রয় ও উষ্ণতার প্রয়োজন ক্রমশ বাড়ছে। কিন্তু বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য নির্ধারিত তাঁবু, কম্বল ও অন্যান্য শীতকালীন সামগ্রী এখনো জর্ডান ও মিসরে সংস্থাটির গুদামেই আটকে আছে। সংস্থাটি অবিলম্বে মানবিক সহায়তা অবাধে প্রবেশ করতে দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।এর আগে গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যম একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশনা সত্ত্বেও ইসরায়েল গাজায় ইউএনআরডব্লিউএর কার্যক্রম পুনরায় শুরু করতে দেবে না।উল্লেখ্য, এর একদিন আগেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) বলেছিল যে, গাজার ফিলিস্তিনিরা যথেষ্ট পরিমাণ মানবিক সহায়তা পাচ্ছেন না। আদালত ইসরায়েলকে অবশ্যই সহায়তা প্রবেশে অনুমতি দিতে এবং ‘অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার’ করা বন্ধের নির্দেশ দেয়।
গাজায় যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে ইসরায়েলি হামলা
এ বিভাগের আরো খবর/p>