ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় বর্বর হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। উপত্যকাটিতে দখলদার বাহিনীর হামলায় একদিনে আরও ৫৩ জন নিহত হয়েছেন। একইসঙ্গে গাজা সিটিতে অবস্থানরত লাখো মানুষকে শহর ছাড়তে শেষবারের মতো হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইসরায়েল। এমনকি গাজা সিটিতে থেকে যাওয়া সবাইকে ‘সন্ত্রাসী কিংবা সন্ত্রাসীদের সমর্থক’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়েছে। গতকাল শুক্রবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা।সংবাদমাধ্যমটি বলছে, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় গত বৃহস্পতিবার ভোর থেকে অন্তত ৫৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। একই সঙ্গে গাজা সিটিতে অবস্থানরত লাখো মানুষকে শহর ছাড়তে ‘শেষ সুযোগ’ দিয়ে হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল, তা না হলে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে।ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লেখেন, গাজা সিটিতে থেকে যাওয়া সবাইকে ‘সন্ত্রাসী কিংবা সন্ত্রাসীদের সমর্থক’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।আল জাজিরা বলছে, ইসরায়েলি বিমান ও স্থল হামলায় গাজা সিটি কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন ডজনের পর ডজন মানুষ নিহত হচ্ছে, ভেঙে পড়ছে আবাসিক ভবন ও স্কুল। হাজারো মানুষ বাধ্য হয়ে দক্ষিণের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে, তবে পালানোর পথেও হামলার মুখে পড়ছেন তারা।আল জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার আল-রাশিদ সড়ক দিয়ে ইসরায়েলি সেনারা মানুষকে শহর ছাড়তে বাধ্য করেছে, আবার উপকূল ধরে দক্ষিণমুখী হওয়ার পথেও হেলিকপ্টার, ড্রোন ও ট্যাংক দিয়ে তাদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। এতে সৃষ্টি হয়েছে চরম আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা।তিনি বলেন, ‘মানুষ গাজা সিটি ছাড়ছে না মূলত ভয় আর ইসরায়েলি সেনাদের ভয়ঙ্কর তৎপরতার কারণে।’চিকিৎসা সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার গাজা সিটিতে অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন। দক্ষিণ গাজায় ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন আরও ১৩ জন। চলমান দুর্ভিক্ষে খাদ্য সংগ্রহে গিয়ে ইসরায়েলি হামলায় নিহতের সংখ্যা এখন প্রায় ২ হাজার ৬০০, আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৯ হাজার।আল জাজিরাকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া ইসরায়েলি এই আগ্রাসনে গাজায় মোট প্রাণহানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ২২৫ জনে। আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৬৮ হাজার ৯৩৮ জন। আর এ বছরের মার্চে ইসরায়েল একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করার পর থেকে নিহত হয়েছেন ১৩ হাজার ৩৫৭ জন।অধিকারকর্মীদের আটক ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর হাতে গাজামুখী ত্রাণবাহী ‘গ্লোবাল সামুদ ফ্লোটিলা’র প্রায় সব নৌযান আটকের ঘটনায় উত্তাল হয়ে উঠেছে বিশ্ব। সুইডিশ জলবায়ুকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ ৪৫০ জনের বেশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কর্মীকে আটকের পর ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।বৃহস্পতিবার রাতের এ অভিযানের সময় কিছু নৌযানে থাকা লাইভ ক্যামেরায় ধরা পড়ে ইসরায়েলি সেনারা হেলমেট ও নাইটভিশন পরা অবস্থায় জাহাজে উঠে যাত্রীদের অপহরণ করছে। যাত্রীরা তখন লাইফ ভেস্ট পরে হাত উঁচিয়ে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিমায় বসে পড়েন।ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আলোচিত পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ ডেকের এক কোণে বসে আছেন এবং তার চারপাশে দাঁড়িয়ে আছে সশস্ত্র সেনারা।ফ্লোটিলার কর্মীদের আটক করার প্রতিবাদে ইউরোপের বহু শহরে ফিলিস্তিনপন্থী বিক্ষোভ হয়েছে। করাচি, বুয়েনস আইরেস ও মেক্সিকো সিটিতেও বিক্ষোভ হয়েছে। ইতালির শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ৪ অক্টোবর সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে।ফ্লোটিলা আয়োজকরা জানিয়েছে, প্রায় ৪৫০ জন স্বেচ্ছাসেবককে আটক করা হয়েছে, যাদের মধ্যে অনেককে একটি বড় কার্গো জাহাজে তুলে পরে আশদোদের বন্দরে নেওয়া হয়েছে।ফ্লোটিলার ‘ম্যারিনেট’ নামের একটি ছোট নৌযান এখনো ইসরায়েলের বাধার মুখে পড়েনি। এটি পোলিশ পতাকা বহন করছে এবং গাজা উপকূল থেকে প্রায় ৮০ নটিক্যাল মাইল দূরে রয়েছে। আয়োজকদের মতে, এটি অন্য নৌযান আটক হওয়ার স্থান থেকে মাত্র ১০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছে।অপহরণের আগে ধারণ করা এক ভিডিওতে গ্রেটা থুনবার্গ বলেন, যদি আপনি এই ভিডিও দেখেন, তাহলে বুঝবেন আমাকে অপহরণ করা হয়েছে এবং ইসরায়েলি বাহিনী জোরপূর্বক আমাকে নিয়ে গেছে। আমাদের মানবিক মিশন ছিল শান্তিপূর্ণ এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে পরিচালিত।ইতালির পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্তোনিও তাজানি জানান, ইসরায়েল সোম ও মঙ্গলবার ফ্লোটিলা সদস্যদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ফেরত পাঠাতে পারে। চার্টার্ড বিমানে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। ইসরায়েলি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আটকদের সকলে সুস্থ এবং তাদের আশদোদে আনা হয়েছে।তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান গ্লোবাল সমুদ ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি হস্তক্ষেপকে ‘সন্ত্রাসমূলক আচরণ’ আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘গাজায় অনাহারে মৃত্যুবরণ করা শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর এই প্রচেষ্টাকে যারা থামাতে চায়, তারা শান্তির ভাষা বোঝে না।’তুরস্কের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা আনাদোলু জানায়, ইস্তানবুলের প্রধান কৌঁসুলির দফতর ফ্লোটিলায় থাকা ২৪ জন তুর্কি নাগরিককে আটক করার ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে।দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, যেন ফ্লোটিলায় থাকা দক্ষিণ আফ্রিকান নাগরিকদের দ্রুত মুক্তি দেওয়া হয়। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি এনকোসি ম্যান্ডেলা।ফ্লোটিলা আগস্টের শেষদিকে যাত্রা শুরু করে। এতে ছিল ৪০টিরও বেশি বেসামরিক নৌযান, যেগুলোতে ছিলেন ইউরোপ ও অন্যান্য দেশের সংসদ সদস্য, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীরা। নৌবহরটি গাজার জন্য খাদ্য ও ওষুধ বহন করছিল।আন্তর্জাতিক আইনজীবী ও অধিকারকর্মীদের মতে, ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি অবরোধ আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং এটি ‘গণহত্যা কনভেনশন’-এর বিরুদ্ধেও দাঁড়ায়।
গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা অব্যাহত, নিহত আরও ৫৩
এ বিভাগের আরো খবর/p>